একটি পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ৮:১৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪

একটি পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন

আশরাফুল ইসলাম ফয়সাল : দৈনন্দিন জীবনে নিত্য পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আমরা পলিথিনের উপর অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। পলিথিনের যেন কোন বিকল্পই নেই। অথচ একটা সময় ঘরে ঘরে চটের ব্যাগের প্রচলন ছিল। পলিথিন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলোকে মাথায় রেখে ২০০২ সালে পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়। এতে বলা হয়, পলিথিনের শপিং ব্যাগ বা অন্য যে কোনো সামগ্রী, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, সেসব উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, পরিবহন ইত্যাদি নিষিদ্ধ। কিন্তু পলিথিনের ব্যবহার রোধের বিষয়টি দেশব্যাপী যে গুরুত্ব হারিয়েছে সেটি বাজারে গেলে বা রাস্তায় সামান্য একটু হাঁটলেই বোঝা যায়। প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ প্লাস্টিক দূষণের কার্যকর ব্যবস্থাপনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। পলিথিন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু বিদ্যমান আইনের দুর্বল প্রয়োগ, জনসচেতনতার অভাব এর সঠিক তদারকির অভাবের কারণে ফলাফলগুলি আশানুরূপ হয়নি। পলিথিন নিষিদ্ধ করার আইনি পদক্ষেপের পরেও বাজারে এর অবাধ ব্যবহার, বিশেষ করে ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে, রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আইনটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হলে কঠোর তদারকি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিকল্প পণ্য ব্যবহারের সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পলিথিনের সহজলভ্যতা এবং সস্তা বিকল্পের অভাবে জনগণ এখনও এ পরিবেশবিধ্বংসী উপাদানের উপর নির্ভরশীল। বাজারে পলিথিনের বিকল্প, যেমন কাগজ বা পাটের ব্যাগ, সহজে পাওয়া গেলে এবং এগুলোর ব্যবহার উৎসাহিত করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

পলিথিন হলো প্লাস্টিকের একটি পরিবর্তিত রূপ, যা প্রাকৃতিকভাবে সহজে পচে না বা ভেঙে যায় না। এটি বায়োডিগ্রেডেবল নয়, অর্থাৎ এটি মাটিতে মিশে না এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী পরিবেশে থেকে যায়। এটি মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছ তার চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। যার ফলে মাটির গুণগত মান হ্রাস পায়। মাটি ও পানিতে প্লাস্টিক কণা ছড়িয়ে পড়ে। গাছ তার খাবার পায় না এবং বৃষ্টির পানিতে এ প্লাস্টিক কণা মাটি থেকে পানিতে মাছের শরীরেও প্রবেশ করে। আর তা মানুষের শরীরে এসে পৌঁছায়। প্লাস্টিক মানুষের শরীরে আরো অনেক মরণ ব্যাধির পাশাপাশি ক্যান্সারের জন্য দায়ী। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা এ পলিথিন উদ্ভাবনের পর থেকেই পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে সতর্ক করে যাচ্ছেন।

যদিও প্লাস্টিককে আমরা সস্তা এবং ব্যবহারযোগ্য মনে করি, এর প্রকৃত মূল্য পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে লবণ, চিনি, মাছ, এবং এমনকি পানীয় জলেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণা, যা সাধারণত ৫ মিলিমিটার বা তার কম আকারের হয় এবং এটি পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানে মিশে যায়। মায়ের দুধেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কম দামের প্লাস্টিকে সাময়িক লাভ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির পরিমাণই বেশি।

পলিথিন বা প্লাস্টিকের বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলে দিলে তা নর্দমায় আটকে গিয়ে পানির প্রবাহে বাধা দেয়। একটু বৃষ্টি হলেই জমে যায় পানি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের মতে, দেশের প্লাস্টিক ও পলিথিন মূলত মাটি ও নদীতে গিয়ে জমা হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এখানে কী পরিমাণে প্লাস্টিক জমা হয়েছে, তা চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে। নয়তো এ দেশের মাটি ও পানি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। এখানে ফসল ফলানো ও মাছ চাষ কঠিন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার কারখানায় দৈনিক ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হয়, যার বেশির ভাগই ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এসব কারখানার দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে দূষণ বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রধান নদ-নদীর বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে পড়ে সাগরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। শুধু ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক ও পলিথিন পড়ে, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

এ চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে একটি বহুমুখী পদ্ধতি প্রয়োজন। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর কাজ কীভাবে শুরু হবে, প্লাস্টিকের বিকল্প কী হবে, এবং সঠিক রিসাইকেল ব্যবস্থাপনা কি হবে এসব নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। জাতীয় পর্যায়ে পলিথিনের ব্যবহার হ্রাস করার পদক্ষেপ নিলেও এর উপযুক্ত ও বিকল্প কিছু না বের করায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে আমাদের আগে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। বিকল্পটি পলিথিনের চেয়ে সহজলভ্য, সাশ্রয়ী হতে হবে। তাহলে আইন বাস্তবায়ন সম্ভব।

দোকান, কারখানা প্রকাশ্যেই পলিথিনের বিকল্প এক ধরনের ব্যাগের উৎপাদন চলছে বাংলাদেশে। কিন্তু তা দেশের বাজারে নয়, রপ্তানি করা হচ্ছে পশ্চিমা দেশে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ২০১৭ সালে ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কাসাভা নামের এক ধরনের ফসলের খোসা ব্যবহার করে ব্যাগ তৈরি শুরু হয়। পরের বছর ইন্দোনেশিয়া থেকে একটি যন্ত্র এনে চট্টগ্রামের হালিশহরে কারখানা স্থাপন করে ইকোস্পিয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও ২০১৫ সালে পাটের পলিথিন ব্যাগ উদ্ধাবনের কথা জানিয়ে আলোড়ন তোলেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মোবারক আহমেদ। তাঁকে স্বর্ণপদকও দেয় সরকার। পাট থেকে সেলুলোজ সংগ্রহ করে তা দিয়ে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। এটি দেখতে সাধারণ পলিথিনের মতই, তবে তা পচনশীল। ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে সে ব্যাগ এখনো বাজারে আনা সম্ভব হয়নি।

প্লাস্টিক তথা পলিথিনের ব্যবহার কমাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাটজাত পণ্যের মোড়কের বহুল ব্যবহারের উদ্যোগ। ডিসেম্বরের মধ্যেই ব্যবসায়ীদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে পলিসি সহায়তা দেবে বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে দেশের সুপার শপগুলোতে পলিথিন শপিং ব্যাগ ও পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পণ্য বহনের জন্য ক্রেতাদেরকে আর পলিথিন ব্যাগ দেওয়া হবে না। বিকল্প হিসেবে পাট ও কাপড়ের তৈরি ব্যাগ ক্রেতাদের কেনার জন্য রাখা হবে। সম্প্রতি সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা এবং ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে জরুরি ভিত্তিতে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। এছাড়াও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধ করে সকল সরকারি অফিসে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যসামগ্রী ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার অনুরোধের প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়।

মানুষ সচেতন হলে পলিথিনের ব্যবহার কমে যাবে এবং এর ফলে দূষণও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। এজন্য প্রচার ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণকে পলিথিনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি, প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ে নানা আন্দোলন ও সামাজিক উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এনজিও ও সুশীল সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং প্লাস্টিকের টেকসই বিকল্প প্রচারে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। সামগ্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর এবং টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।