২৮শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৪
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : স্বাগত ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতীয় ইতিহাসের এই দিনটি একদিকে স্মরণের অন্যদিকে উজ্জীবিত হবার। আমাদের মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে আনার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছে বাংলা মায়ের ধামাল ছেলেরা। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সে আত্মদানের কথা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের স্বীকৃতির ফলে কার্যত ভাষা শহীদরাও বিশ্বব্যাপী বিরল সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। হাজার বছর ধরে জাতির অভ্যন্তরে যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লালিত হয়ে আসছিল কার্যত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদনায় তমুদ্দুন মজলিস-এর উদ্যোগে পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা বের হয়। তখন তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ও গঠিত হয়। এ পরিষদ নানা সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরার চেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মজলিসের উদ্যোগে ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট এবং প্রদেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ একটি মাইলফলক। এ ধর্মঘটের কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এগিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৭ দফা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে উর্দুর সাথে বাংলা ভাষাকেও সমান মর্যাদা প্রদান এবং পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার প্রতিশ্রতি দেয়া হয়। ফলে এ দেশের মানুষ ধরে নিয়েছিল তারা তাদের মুখের ভাষার মর্যাদা ফিরে পাবে। কিন্তু সরকার অচিরেই এ দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করলো। ১১ মার্চ থেকে ২১ মার্চ এর মধ্যেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ২১ মার্চ পাকিস্তানের জনক ও তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে এলেন। তখন কার্জন হলে আয়োজিত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অপর কোনো ভাষা নয়।’ কায়েদে আযমের এ ঘোষণা ছিল এ দেশের মানুষের স্বপ্ন আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে প্রচন্ড আঘাত। তাই এ ঘোষণার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো দেশ। ফের শুরু হলো ভাষার আন্দোলন। প্রতিবাদ প্রতিরোধে কেঁপে উঠলো সারাদেশ। ভাষার দাবিতে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ ও ¯েøাগানে বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। মানুষ আশা করেছিল সরকার এ দেশের জনগণের দাবিকে মর্যাদা দেবে এবং বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নেবে। ঘটনা ঘটলো উল্টো। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশন। এখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করলেন : ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ দেশের মানুষ আরেকবার হতাশ হলো। তারা আর স্থির থাকতে পারলো না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিবাদে আবার জেগে উঠলো দেশ। ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় পালিত হলো প্রতিবাদ দিবস।
এখানেই থেমে থাকেনি দেশের মানুষ। তাদের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ তীব্র হতে থাকলো। ফলে ভাষার আন্দোলন আরো সংগঠিত হলো। ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবার জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে গঠিত হলো ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ নামে। শুরু হলো নতুন উদ্যমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। ’৪৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ছাত্র-কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় ভাষার দাবি বেগবান হয়েছিল। চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলন পরিচালনায় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবির চেতনার মূলে বিশেষভাবে কাজ করেছে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। সামগ্রিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা বলা যায়, এই আন্দোলনের স্বাপ্নিকগণ এবং লালন ও চর্চাকারী সকলেই সচেতন মুসলমান ও ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। সে কারণে ভাষার অধিকারের পথ ধরেই গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অধিকারের দাবি উচ্চারিত হয়েছিল। শুরু হয়েছিল, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের সংগ্রাম। এর পর ’৭০-এর নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। রাজনৈতিক ও গবেষকদের বিশ্লেষণের সূত্র ধরেই বলা যায়, ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র নিছক একটি আন্দোলন অথবা ভাষারই আন্দোলন ছিল না, বরং চেতনা সঞ্চারী এই আন্দোলন ভেতরগত অবিনাশী চেতনার স্মারক হয়ে রয়েছে। এই চেতনা স্বাধীনতার রক্ষাকবচও বটে।
আমাদের এ মহান ভাষা আন্দোলন এবং তারই পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের দরবারে আমাদের গৌরবকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে। আমরা আরো বেশি গর্বিত হয়েছি যখন আমাদের ভাষা দেশের গন্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্বের কাছেও স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আমাদেও শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’র স্বীকৃতি পেয়ে গৌরবের আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছে। আর এ মহান কাজে যারা অবদান রেখেছেন তারাও বাংলাদেশী। তারা এ জাতির কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশ্বে বাংলাভাষা জনগণের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে পাকিস্তান, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল সংখ্যক বাঙালির বসবাস। মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশ মালয়েশিয়া, কোরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী বসবাস করছেন। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের বাংলাভাষী সৈনিকদের কর্মকান্ডে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আফ্রিকান দেশ সিয়েরালিয়ন বাংলা ভাষাকে সে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে থেকে পাকিস্তান ও ভারতে বাংলাভাষা অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এদিক থেকে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইতোমধ্যে মর্যাদার দাবিদার।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী বিক্ষোভ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করল। অথচ সরকার জনগণের এ দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য একই দিন ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং জারি করল ১৪৪ ধারা। কিন্তু তাতেও মানুষের ক্ষোভকে থামানো যায়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বাধা আসে পুলিশের। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে দমন করতে পুলিশ মিছিলের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্র মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে শহীদ হন, জব্বার, বরকত, সালামসহ আরও অনেকে, আহত হন বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। ২২ তারিখ নিহতদের গায়েবানা জানাজা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। এ ঘটনার পর ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠে। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে তাদের ভাষা, স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা নিরাপদ নয়। তাই ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা লড়াইয়ে মানুষ অর্জন করে মহান স্বাধীনতা।
মূলত ভাষা আন্দোলনের চেতনা হচ্ছে, জাতীয় ঐক্যের এবং জাতীয় সমৃদ্ধির। এবারে যখন ভাষা দিবস পালিত হতে যাচ্ছে, তখন কার্যত জাতি দ্বিধাবিভক্ত। গভীর সংকটে রয়েছে, জাতীয় মানস। সংকট অতিক্রমে ২১-এর অবিভাজ্য চেতনার প্রয়োজন।
লেখক- গবেষক ও কলামিস্ট, পাঠান পাড়া (খান বাড়ী) কদমতলী, সিলেট।
EDITOR & PUBLISHER :
DR. ARIF AHMED MOMTAZ RIFA
MOBILE : 01715110022
PHONE : 0821 716229
OFFICE : SHUVECHCHA-191
MIAH FAZIL CHIST R/A
AMBAKHANA WEST
SYLHET-3100
(Beside Miah Fazil Chist Jame Masjid & opposite to Rainbow Guest House).
E-mail : sylhetsangbad24@gmail.com
Hello : 01710-809595
Design and developed by M-W-D