গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে সর্বমহলের প্রবল আপত্তি

প্রকাশিত: ২:৫৬ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৬, ২০১৬

শিল্পখাতে মারাত্মক ক্ষতির আশংকায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা ॥ দিশেহারা হয়ে পড়বে নিম্ন-মধ্যবিত্ত 

767কামাল উদ্দিন সুমন : গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সর্বমহল থেকে প্রবল আপত্তি উঠেছে। এসব কিছু উপেক্ষা করে গ্যাসের দাম পুনঃনির্ধারণ নিয়ে আগামীকাল থেকে গণশুনানি শুরু করছে

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ঐ দিন সকাল ১১টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার টিসিবি ভবনে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লি:(জিটিসিএল) এর গ্যাস ট্রান্সমিশন চার্জ নিয়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে সচিব ফয়জুর রহমান স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণশুনানির বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে বিইআরসি।

এদিকে গ্যাসের দাম না বাড়াতে ব্যবসায়িরা প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, সরকার গ্যাসের দাম আবারো বাড়ালে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ব্যবসা বানিজ্য। বন্ধ হবে অনেক শিল্পকারখানা। এছাড়া গ্যাসের দাম বাড়ালে সারা দেশ অচল করে দেওয়ার ঘোষনাও দিয়েছে সিএনজি ফিলিং ষ্টেশনের মালিকরা। এছাড়া গ্যাসের দাম বাড়লে গ্রাহকরা দিশেহারা হয়ে পড়েবে ।

সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আবারো বাড়ছে সব ধরনের গ্যাসের দাম। ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গড়ে ৮৮ শতাংশ দাম বাড়নোর প্রস্তাব নিয়ে কাল থেকে গণশুনানি শুরু হচ্ছে।

বিইআরসি জানিয়েছে প্রথমদিন গণশুনানি হবে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লি. (জিটিসিএল) এর। এরপর পর্যায়ক্রমে ৮ আগষ্ট তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি:,১০ আগষ্ট পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লি., ১১ আগষ্ট বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি., ১৪ আগষ্ট কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি., ১৬ আগষ্ট জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি., ১৭ আগষ্ট সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লি. এবং ১৮ আগষ্ট পেট্রোবাংলা, বিজিএফসিএল, এসজিসিএল ও বাপেক্স এর গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের উপর গণশুনানি হবে। প্রতিদিন সকাল ১১টায় শুনানি শুরু হবে।

সূত্র জানায়, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো আবাসিক দুই চুলা ৬৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, এক চুলা ৬০০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা আর প্রতি ঘনমিটার সাত টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা ৮০ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে। শিল্পকারখানার ক্যাপটিভ পাওয়ারে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম আট টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৯ টাকা ২৬ পয়সা, যানবাহনের সিএনজি ৩৫ থেকে ৫৮ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া বিদ্যুতে প্রতি ঘনমিটার দুই টাকা ৮২ পয়সা থেকে চার টাকা ৬০ পয়সা, শিল্প বয়লারে ছয় টাকা ৭৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে ব্যবসা বাণিজ্যের গতি ব্যাহত হবে জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়িদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।

উদ্বেগ প্রকাশ করে ডিসিসিআই জানায়, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনায় ডিসিসিআই গভীর উদ্বিগ্ন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার দাবি জানাচ্ছে ডিসিসিআই।

ডিসিসিআই মনে করে, গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে ব্যবসায় ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা কিনা আমাদের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে।

ঢাকা চেম্বার মনে করে, ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতির নানামুখী কর্মকাণ্ড মেটানোর জন্য শিল্পকারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি, তদুপরি সার্বিকভাবে এ মূল্য বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায় ব্যয় আরোও বাড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাকে গতিশীল রাখার জন্য সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ দেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে আমাদের টেক্সটাইল, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাতে ইতোমধ্যে প্রচ- চাপের মধ্যে রয়েছে, তথাপি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পেলে এ খাতগুলোর অগ্রগতির ধারা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্যাসের মূল্য পুনরায় বাড়ানো হলে তৈরি পোশাকখাত এবং অন্যান্য আমদানি বিকল্প রপ্তানি নির্ভর শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে আসবে। বাণিজ্যিক পরিবহন খাতের প্রভাব পড়ার কারণে ব্যবসায় ব্যয় ও পণ্য সরবরাহ (সাপ্লাই চেইন) ব্যয় বাড়ার সম্ভাবনা আছে। যার প্রভাব সাধারণ ভোক্তাশ্রেণীর ওপর গিয়ে পড়বে। এ ধরনের মূল্য বাড়ানো অনৈতিকভাবে অপব্যবহারের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে সহায়তা করে।

গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হলে সার্বিকভাবে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হতে পারে। এছাড়াও শিল্পায়ন, ব্যাবসায় প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে।

এদিকে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ানো হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফিলিং স্টেশন বন্ধ রাখার হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন এন্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপ ওনার্স এসোসিয়েশন।

সংগঠনটি বলছে, এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে পরিবহন ভাড়া আবার বেড়ে দ্বিগুণের বেশি দাঁড়াবে। একইসঙ্গে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে পণ্যের দামও বাড়বে।

বিডিসিএনজি এসোসিয়েশন সভাপতি মাসুদ খান বলেন, আমরা মূল্যবৃদ্ধির শুনানিতে যাব, মূল্যবৃদ্ধি না করতে সুপারিশ করব। তবে মূল্যে বৃদ্ধি করলে অনির্দিষ্টকালের জন্য সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধ করা হবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে সিএনজি স্টেশন ৫৯০টি এবং রূপান্তরিত গাড়ি তিন লাখ এবং থ্রি হুইলার ৫ লাখ। ২০১৫ সালে প্রতি ইউনিট সিএনজি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়। গত ছয় বছরে এর দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ।

সিএনজির দাম বাড়লে সবকিছুর দাম বাড়বে মন্তব্য করে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সরকার যেভাবে দাম বাড়াতে চাচ্ছে তা যৌক্তিক নয়। এই সরকার খুবই যোগ্য তবে আক্কেল কম। তারা যুক্তিতে চলে না। সরকারকে কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। অপরিকল্পিত ব্যয়ের বোঝা জনগণ কেন বহন করবে- এই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সরকার যদি কোম্পানি, নিজের লোকদের স্বার্থ দেখে, তা হলে জনগণ ভয়ংকর রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, এতে দেশীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে এবং হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারকে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এদিকে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব কার্যকর হলে বস্ত্র খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে টেক্সটাইল খাত। প্রস্তাব অনুযায়ী, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৩০ শতাংশ এবং শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য ৬২ শতাংশ বৃদ্ধি করলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকতে হিমশিম খাবেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। গত ২ আগষ্ট বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সঙ্গে দেখা করে এ আশংকার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) নেতারা।

বিটিএমএ’র নেতারা বলেছেন, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে গ্যাসের মূল্য প্রতি কিউবিক মিটার ৪.১৮ টাকা থেকে ৮.৩৬ টাকা করা হয়। শতভাগ মূল্য বৃদ্ধির ফলে টেক্সটাইল সেক্টরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় সক্ষমতা কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে ৮.৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে গ্যাসের দাম ১৯.২৬ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে অনেক টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মসংস্থান হারাবে লাখও শ্রমিক।

বিটিএমএ’র নেতারা বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রীকে আরও বলেন, বিটিএমএ’র মিলগুলো সরকারের গৃহীত নীতিমালার প্রেক্ষাপটে টেক্সটাইল খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনে উৎসাহিত হন। প্রাথমিক অবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়, যা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেক্সটাইল শিল্প স্থাপনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে গ্যাসের ট্যারিফ ১৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করেপ্রতি ঘন মিটার ১৯.২৬ টাকা করার প্রস্তাব টেক্সটাইল খাতকে নিশ্চিতভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইসতিয়াক আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানি থেকে পেট্রোবাংলা গ্যাস কেনে। বেশি দামে গ্যাস কিনে কম দামে বিক্রি করতে হয়। আগে গ্যাস বিক্রিতে ট্যাক্স-ভ্যাট দিতে হতো না। এখন দিতে হবে। তাই কোম্পানিগুলোর ঘাটতি দূর করতে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।