খালেদা জিয়ার ইফতার আজ, কী করবেন শেখ হাসিনা?

প্রকাশিত: ২:০১ পূর্বাহ্ণ, জুন ৫, ২০১৭

খালেদা জিয়ার ইফতার আজ, কী করবেন শেখ হাসিনা?

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : জাতির মধ্যে বিভক্তি, রেষারেষি ও প্রতিহিংসা এখন প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ক্ষমতার মোহে দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার নামে এখন প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের শক্তি, গণতন্ত্র, জাতীয় নির্বাচন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে জাতি আজ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব, প্রতিহিংসা এবং রেষারেষির কারণে জাতির বিভক্তি আজ সুস্পষ্ট। বাঙালিরা জাতি হিসেবে এক হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর এই রেষারেষির কারণে আজ জাতির কাঙ্খিত উন্নয়ন ও অগ্রগতি হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ না হলে রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতি যে কোনোভাবেই সম্ভব নয় সে কথা সর্বজন স্বীকৃত।

বিষয়টি জাতির প্রধান সমস্যা হিসেবে দেশের বুদ্ধিজীবী মহল, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবীদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিককালে বিষয়টি রাজনীতিবিদদেরও নাড়া দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য দ্বন্দ্ব-বিভক্তি নিরসনের যে কোনো বিকল্প নেই সেটা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।

দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরেই চলে আসছে এধরনের বৈরি অবস্থা। তাতে যা হবার তাই হয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে দুই নেত্রীর কথা-বার্তায় ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। যা জাতির সামনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

তারা দুজনেই হানাহানি বন্ধ করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন। তারা উভয়ে আগামী দিনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছেন। বলছেন, জাতির বিভক্তি নিরসনের কথা। বিশেষ করে এক্ষেত্রে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আগ্রহ ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান।

অতি নিকটের কোনো কথা বললে আমরা বলতে পারি- গত ১০ মে ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নুতন দিন। যেদিন প্রথমবারের মতো দেশের কোনো প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা প্রকাশ্যে সুস্পষ্টভাবে বললেন, তারা এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চান। তারা  জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজনের অবসান ঘটাতে চান। শুধু তাই নয়, তারা ভবিষ্যতে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কী কী করতে চান তাও অঙ্গিকার করেন।

ওইদিন সাংবাদিক সম্মেলনে ‘ভিশন ২০৩০’ নামে বিএনপি চেয়ারপারসন একটি মহাপরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

বেগম খালেদা জিয়া বলেন, সকল জনগণের বৃহত্তর সম্মিলনের মাধ্যমে ‘ইনক্লুসিভ সোসাইটি’ গড়ে তোলার মহৎ লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়াই বিএনপি’র নীতি। এ জন্য প্রয়োজন হবে সকল প্রকার বৈষম্য ও ভেদবুদ্ধির (discrimination) বেড়াজালকে অতিক্রম করে দেশ গঠনে সবার কর্মপ্রয়াসকে কাজে লাগানো।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া আরো বলেন, বিএনপি চায় বিভক্ত হয়ে পড়া এ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। তাই সকল মতাদর্শের ঐকতান রচনার জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার সেতুবন্ধ রচনাই হবে বিএনপি’র প্রয়াস।

তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া এও বলেন, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিএনপি। এজন্য নতুন এক সামাজিক চুক্তিতে (Social Contract)পৌঁছাতে বিএনপি সচেষ্ট হবে।

এছাড়া অতি নিকটের আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়,  এইত তিনদিন আগে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান মাহে রমজানের শুভেচ্ছা জানিয়ে গণমাধ্যমে বাণী দিয়েছেন। শুভেচ্ছা বার্তায় তারা- সর্বস্তরে ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা, অকল্যাণ বর্জন করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পরস্পরকে সহযোগিতা, রমজানের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাবতীয় ভোগবিলাস, হিংসা-বিদ্বেষ, উচ্ছৃঙ্খলতা ও সংঘাত পরিহার করে ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।

গত ২৭ মে মাহে রমজান উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবনের সর্বস্তরে ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান।

তিনি বলেন, ‘আসুন, আমরা সকল প্রকার অকল্যাণ বর্জন করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পরস্পরকে সহযোগিতা করি। জীবনের সর্বস্তরে ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করি’

তিনি ‘পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশবাসী ও বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর প্রতি আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়ে বলেন, আত্মসংযম, অনুকম্পা ও ক্ষমা লাভের মাস রমজান। এ মাসে ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষার মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর নৈকট্যলাভের সুযোগ হয়।

শেখ হাসিনা পবিত্র রমজানের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাবতীয় ভোগবিলাস, হিংসা-বিদ্বেষ, উচ্ছৃঙ্খলতা ও সংঘাত পরিহার করে ব্যগতক্তি ও সমাজ জীবনে শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।

‘মহান আল্লাহ আমাদের জাতীয় জীবনে পবিত্র রমজানের শিক্ষা কার্যকর করার তাওফিক দান করুন’- তিনি এই প্রার্থনা করেন।

অন্যদিকে পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষ্যে এক টুইট বার্তায় দেশবাসীকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা জানান দেশের প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

টুইট বার্তায় তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘রহমতের সওগাত নিয়ে সমাগত পবিত্র রমজানের প্রারম্ভে আসুন আমরা মুনাজাত করি অশুভের উপর হক, ইনসাফ, সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা বিজয়ী হোক।’

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের এ ধরনের আহ্বান খুবই ইতিবাচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়টি প্রশংসারও দাবি রাখে।

শুধু তারা আহ্বানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। এরই মধ্যে বেগম জিয়া তার ঘোষণা অনুযায়ী ‘এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে’ বুধবার ইফতারের দাওয়াত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন।

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সম্মানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছেন। আজ (৫ জুন) সোমবার রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের নবরাত্রি হলরুমে এ ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। আর সেই ইফতার মাহফিলে অংশ নিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও এই দাওয়াত পত্র পাঠান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

বুধবার আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই দাওয়াত কার্ড পৌঁছে দেন বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল।

বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইফতার মাহফিলে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপির চেয়ারপারসনের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও প্রেসিডিয়াম সদস্যদের জন্য ইফতারের দাওয়াত কার্ড পৌঁছে দিয়েছেন।

পরস্পরবিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসী দেশের রাজনীতিতে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে এ ধরনের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক রাজনীতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিষয়টি সর্বমহলের দ্বারা প্রশংসারও দাবি রাখে।

রাজনৈতিক বিশ্লষকদের মতে, কোনো দেশে হঠাৎ করেই গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠে না। এজন্য প্রয়োজন হয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার।

ফলে আমরা বলতে পারি- দীর্ঘদিন থেকে রাজনীতির মাঠের আন্দোলন সংগ্রাম, হরতাল-ধর্মঘট থেকে সরে আসা বিএনপি সাম্প্রতিককালে যে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। এতদিন ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বেগম জিয়াকে বিভিন্ন ইস্যুতে দায়ী করা হয়, কিন্তু এবার খালেদা জিয়াই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে দেশ-জাতির স্বার্থে সবক্ষেত্রে সমঝোতা ও সহনশীল রাজনীতির কথা বলছেন।

তবে এক্ষেত্রে শুধু একপক্ষকে এগিয়ে আসলেই হবে না, প্রয়োজন ক্ষমতাসীনদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা এবং গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ তৈরি করা। কেননা, দেশে দীর্ঘসময় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি জাতিকে বিপথের দিকে ধাবিত। এখন দেখার বিষয়- বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি  ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও প্রেসিডিয়াম সদস্যদের জন্য ইফতারের যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সেই ইফতারে তারা অংশ নেন কীনা। পরস্পরের দূরত্ব কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন কীনা। আমরা আশা করবো, তারা এই আমন্ত্রণে সাড়া দিবেন। এর ফলে দেশের গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফক হিসেবে কাজ করবে।

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট