২৮শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৩২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৬, ২০২৪
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : প্রাচীনকাল থেকেই আশুরার ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। হজরত হুসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদতের ঘটনার অনেক আগ থেকেই আশুরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যঘেরা দিন।
তবে এ কথা সত্য ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) তার দলবলসহ শহিদ হওয়ার ঘটনা এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ কারণে মুসলমানরা দিনটিকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকেন এবং প্রত্যেক মুসলমানের কাছে এর গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ।
আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে-হজরত মুসা (আ.)-এর ফিরাউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ। এই দিনে মহান আল্লাহতায়ালা চিরকালের জন্য লোহিত সাগরে ডুবিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন ভ্রান্ত খোদার দাবিদার ফিরাউন ও তার বিশাল বাহিনীকে।
অনেকে মনে করেন, ফিরাউন নীলনদে ডুবে ছিল। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী এ ধারণা ভুল। বরং তাকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়া হয়।
হিজরি ৬০ সালে পিতার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসাবে ঘোষণা করে। অথচ ইয়াজিদ প্রকৃত মুসলমান ছিল না, বরং সে মোনাফিক ছিল। সে এমনই পথভ্রষ্ট ছিল যে, ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ মদ্যপানকে সে বৈধ ঘোষণা করেছিল। অধিকন্তু সে একই সঙ্গে দুই সহোদরকে বিবাহ করাকেও বৈধ ঘোষণা করেছিল।
শাসক হিসাবে সে ছিল স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। এসব কারণে হজরত হোসাইন (রা.) শাসক হিসাবে ইয়াজিদকে মান্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং কুফাবাসীর আমন্ত্রণ ও ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে মদিনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন। উল্লেখ্য, উমাইয়াদের শাসনামলে ইসলাম তার মূল গতিপথ হারিয়ে ফেলেছিল। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে যাত্রা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কারবালার উদ্দেশে যাত্রা করেন।
এ সময় উমর ইবনে সাদ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে। কয়েক ঘণ্টা পর ইসলামের জঘন্য দুশমন শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরও বহু নতুন সৈন্য এসে আবি ওক্কাসের বাহিনীর সঙ্গে যোগ হয়। অবশেষে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। এ যুদ্ধ সত্য এবং মিথ্যার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম।
কারবালায় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। এ অসম যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার ৭২ জন সঙ্গী শাহাদতবরণ করেন। শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদি নিজে ইমাম হোসাইনের কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। আর সে বেদনাহত দিনটা ছিল হিজরি ৬১ সালের ১০ মহররম।
আশুরা দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালায় অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে শাহাদতবরণ করেছিলেন; কিন্তু তিনি অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি।
ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তার এ বিশাল আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
কারবালার ঘটনা থেকে মানবগোষ্ঠীর জন্য যেসব শিক্ষা রয়েছে, তন্মধ্যে প্রধান হচ্ছে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তবু ক্ষমতার লোভে ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। খেলাফতকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরে ইয়াজিদের বলপ্রয়োগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন।
বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে প্রতিরোধ সংগ্রামের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। কারবালা প্রান্তরে সত্য ও ন্যায়কে চির উন্নত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। ঐতিহাসিক ১০ মহররম চিরকাল বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে।
এভাবে পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে আশুরার দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত এক অনন্য, অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যই কারবালায় নবি বংশের আত্মত্যাগ হয়েছিল।
মূলত আশুরার দিনে মুসলমানরা ন্যায় প্রতিষ্ঠাকল্পে আত্মত্যাগের এক অনুপম আদর্শ শিক্ষাগ্রহণ করেন। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতালিপ্সা ও মসনদের লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের শাশ্বত নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত করলেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে।
কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সত্যের জন্য শাহাদতবরণের এ অনন্য দৃষ্টান্ত ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ১০ মহররমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। আশুরা দিবসে কারবালার শিক্ষণীয় এবং করণীয় হলো, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামীদের সামনে প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো সময় অর্থ, বিত্ত ও সম্মানের লোভনীয় প্রস্তাব এলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে আপসহীন মনোভাবের মাধ্যমে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে।
কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর আশুরার শাশ্বত বাণী তাই অন্যায় প্রতিরোধ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
আশুরা এ মহান শিক্ষা দিয়েছে যে, সত্য কখনো অবনত শির হতে জানে না। বস্তুত কারবালা ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণতন্ত্রের লড়াই। ইসলামি আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.); কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আপস করেননি। জীবনের চেয়ে সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য নবি-দৌহিত্রের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ জগতের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল ঘটনা।
কারবালার শোকাবহ ঘটনায় চিরন্তন সত্যের মহাবিজয় হয়েছিল এবং বাতিলের পরাজয় ঘটেছিল। সুতরাং আশুরার এ মহিমান্বিত দিনে শুধু শোক বা মাতম নয়, প্রতিবাদের সংগ্রামী চেতনা নিয়ে হোক চির সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ-এটাই মহররমের অন্তর্নিহিত শিক্ষা। কারবালার কথকতা শুধু শোকের কালো দিবসই নয়, এর মধ্যে সুপ্ত রয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কঠিন শপথ নেওয়ার এক সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক
EDITOR & PUBLISHER :
DR. ARIF AHMED MOMTAZ RIFA
MOBILE : 01715110022
PHONE : 0821 716229
OFFICE : SHUVECHCHA-191
MIAH FAZIL CHIST R/A
AMBAKHANA WEST
SYLHET-3100
(Beside Miah Fazil Chist Jame Masjid & opposite to Rainbow Guest House).
E-mail : sylhetsangbad24@gmail.com
Hello : 01710-809595
Design and developed by M-W-D