রোজার নিয়মাবলি : স্বাগতম মাহে রমজান

প্রকাশিত: ১০:৫৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২, ২০২২

রোজার নিয়মাবলি : স্বাগতম মাহে রমজান

 || মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার ||

রোজার শাব্দিক অর্থঃ-
রোজা ফারসি শব্দ। এর আরবি হল صَوۡم {সাওম}। এর ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য صِّيَامَ সিয়াম। সাওমের শাব্দিক অর্থ হল বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা। যেমন পবিত্র কোরআনের সূরা মারয়ামে বলা হয়েছে।

“বলে দাও, আমি করুণাময়ের জন্য রোযার মানত মেনেছি, তাই আজ আমি কারোর সাথে কথা বলবো না।” {আয়াত-২৬ সূরা মারয়াম}।

#রোজার_পারিভাষিক_অর্থঃ-
সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর জন্যে খানা খাওয়া, পান করা, ও স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থাকার নাম সওম। পবিত্র কোরআন মজীদে বলা হয়েছে।

অর্থাৎ তোমরা পানাহার করতে থাকো। যতক্ষণ না রাত্রির কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। তখন এসব কাজ ত্যাগ করে রাত পর্যন্ত নিজের রোযা পূর্ণ করো। {আয়াত-১৮৭ সূরা বাকারাহ}।

#রোজার_প্রকারভেদঃ-
রোজা ৫ প্রকার (১) ফরজ {২} ওয়াজেব {৩} সুন্নাত/মস্তাব/নফল (৪) মাকরূহ (৫) হারাম।

#ফরজ রোজা :- রমজানের পূর্ণ মাস রোজা রাখা ও তার কোনটি কাযা হলে পরে পূর্ণ রোজা রাখা।

#ওয়াজেব রোজা :- মান্নতের রোজা। কাফ্ফারার রোজা ওয়াজিব।

#সুন্নতে_গায়ের_মোয়াক্কাদা/মুস্তাহাব/নফল রোজা :- মহররমের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখের ২টা রোজা। যিলহজ্জের ৯ তারিখে, প্রতি আরবি মাসের ১৩. ১৪. ১৫ তারিখে, শাওয়াল মাসের {ঈদের পর} ৬টি রোজা, জিলহজ্জ মাসের প্রথম ৮টি রোজা, প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা, শা’বানের ১৫ তারিখে রোজা রাখা, যুলহজ্জ মাসের প্রথম ৮ দিন রোজা সুন্নত। ফকিরগণ এসব রোজার মধ্যে কোক কোনটিকে নফল আবার কোন কোনটিকে মুস্তাহাব বলেছেন।

#মাকরূহ_রোজা :- রমজানের চাঁদ দেখার ব্যাপারে সন্দেহের দিন রোজা, কেবল মাত্র শুক্রবার ও শনিবার রোজা রাখা, নববর্ষ বা বিধর্মীদের উৎসবের দিনে রোজা, স্বামীর বিনা অনুমতিতে মহিলাদের জন্যে নফল রোজা, শুধু মহররমের ১০ তারিখের রোজা [অর্থাৎ আগ বা পরে এক দিন না মিলান],কোন প্রকার বিরতি ছাড়া ক্রমাগত রোজা রাখা মাকরূহ।

#হারাম রোজা :- ঈদুল ফিতরের দিন, ঈদুল আযহার দিনে ও আইয়ামে তাশরিক অর্থাৎ যিলহজ্জের ১১. ১২ ও ১৩ তারিখের এই মোট ৫ দিনে রোজা রাখা হারাম। এছাড়া হায়েয ও নেফাস অবস্থায়ও রোজা রাখা হারাম।

#রোজার শর্তঃ-
রোজার শর্তাবলীর প্রশ্নে বিভিন্ন ফকীহদের মধ্যে মত পার্থক্য থাকলেও মোটামুটিভাবে দুটি ব্যাপারে তাদের মধ্যে ঐক্যমত দেখা যায়। (ক) রোজার ফরজ হওয়ার শর্ত (খ) রোজা শুদ্ধ হওয়ার শর্ত।

#রোজা ফরজ হওয়ার শর্ত :- ১) মুসলমান হওয়া ২) বালেগ হওয়া ৩) মানসিক দিক হতে প্রকৃতিস্থ হওয়া ও শারীরিক দিক থেকে সক্ষম হওয়া {মাযু’র নয়}।

#ফরজ বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত :- (১) রোজার নিয়ত থাকতে হবে। মুখে বলা জরুরী নয় মনে মনে নিয়ত করলেও হবে। (২) মহিলাদের ক্ষেত্রে হায়েয ও নিফাস হতে পাক হতে হবে।
রোজার ফরজ ও সুন্নতঃ-

#রোজার ফরজ ৩টি
১. কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকা।
২. কিছু পান করা থেকে বিরত থাকা।
৩. যৌন বাসনা পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকা। {আয়াত-১৮৭ সূরা বাকারাহ}

#রোজার সুন্নত ৩টি
১. যৎসামান্য হলেও সেহরি করা।
২. শেষ সময়ে সেহরি ও প্রথম সময়ে ইফতার করা মুস্তাহাব।
৩. রোজার নিয়ত রাতেই করে নেয়া।

#যে যে কারণে রোজা ভঙ্গ হয়নাঃ-
{ক} খাদ্য ও পানীয় ধরনের বিষয়
১. ভুলে খানা পিনা করলে
২. স্বপ্নে কিছু খেয়ে বা পান করলে
৩. রোজার স্মরণ থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় থুথু, মুখের লালা বা অনুরূপ কিছু গিলে ফেললে।
৪. অনিচ্ছাকৃত ভাবে মুখের মধ্যে মাছি, ধুলাবালি, বা ধুয়া পেটে ঢুকলে।
৫. দাঁতের মধ্যকার ছোলার দানার চেয়ে ছোট কোন খাদ্য টুকরো দাঁতের মধ্য হতে বের করে গিলে ফেললে।
৬. অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ ভরে বমি হলে।
৭. গরমের কারণে অধিক মাত্রায় হাত, মুখ ধুলে, গোসল করলে, ভিজে জামা কাপড় গায়ে জড়িয়ে রাখলে।
৮. স্বাদ অনুভব হউক বা না হউক তাজা মেছওয়াক দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করলে।
৯. থুথুর সাথে দাঁতের গোড়া বা অন্যত্র হতে বের হওয়া রক্ত যা থুথুর চেয়ে কম ও স্বাদবিহীন অবস্থায় পেটে গেলে।
১০. কানের ভিতর তৈল দিলে।
১১. দিনের বেলায় সুরমা লাগালে, মাথায় তেল দিলে, শরীরে তেল মালিশ করলে, ধোয়াবিহীন খুশবু গ্রহণ করলে।
১২. পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে রান্না তরকারি বা খাদ্যের স্বাদ পরীক্ষা করলে এবং তা কন্ঠনালির নিচে না প্রবেশ করলে রোজা ভঙ্গ হয় না।

{খ} স্ত্রীসহবাস বা তার অনুরূপ কার্যক্রমঃ
১. ভুলে স্ত্রী সহবাস করে ফেললে।
২. দিনের বেলা স্বপ্নদোষ হলে।
৩. স্ত্রীর সাথে শুয়ে থাকা, কাপড় অবস্থায় দেহ জড়িয়ে ধরা, চুমো দেয়া জায়েজ, তবে বীর্যপাতের আশংকা বা কামোত্তেজনা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকলে জায়েজ নয়।
৪. বিনা ইচ্ছায় যে কোন যৌন উত্তেজনা কর পরিস্থিতি চোখে পড়ার কারণে বীর্যপাত হলে রোজা নষ্ট হয় না।

#যে যে কারণে রোজা মাকরূহ হয় তবে নষ্ট হয়না
১. কোন পরিবেশ পরিস্থিতির চাপ ছাড়াই কোন খাদ্য দ্রব্যের স্বাদ পরীক্ষা করা।
২. মাজন পেস্ট অথবা কয়লার গুঁড়া দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা।
৩. ইচ্ছা করে মুখের মধ্যে ধোঁয়া, লুবানের ধোঁয়া, ধুলা বালি গ্রহণ।
৪. ফরজ গোসলের প্রয়োজন ছিলো, সুযোগও ছিলো, কিন্তু ইচ্ছা করে সুবহে সাদিকের পূর্বেও গোসল না করা।
৫. রোজা রেখে গীবত করা, মিথ্যা বলা, গালি দেওয়া, মারপিট করা, কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করায় মাকরূহ হয়ে যায়।
৬. স্ত্রীর ঠোঁট মুখের মধ্যে নেয়া তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় জড়িয়ে ধরা, তাই বীর্যপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকুক বা নাই থাকুক উভয় অবস্থায় মাকরূহ আর এরূপ অবস্থায় বীর্যপাত হলে রোজা কাযা করতে হবে।

ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রমজান মাসের রোজা অন্যতম ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় হিজরিতে কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা উম্মতের উপর রোজা ফরজ করেছেন।

রমজানের রোজা কেউ যদি অস্বীকার করলে— সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। এছাড়াও শরিয়ত সমর্থিত ওজর (অপারগতা) ছাড়া ইচ্ছাকৃত রোজা ভঙ্গকারী— মৌলিক ফরজ লংঘনকারী ও ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারীরূপে গণ্য। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ওজর বা অসুস্থতা ছাড়া রমজানের একটি রোজা পরিত্যাগ করবে— সে যদি ওই রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখে তবু ওই এক রোজার ক্ষতিপূরণ হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৭২৩)
রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘…সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আপনাকে আমাকে আমাদের সকলের সিয়াম সাধনাকে কবুল করুন আমীন ।


লেখক:-: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক বাংলা পোস্ট |√| বিশেষ প্রতিবেদক দৈনিক নয়াদেশ |√| ও প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা |√|


 

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট