১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১লা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:০০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী : ওয়াদা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় কারো সাথে কেউ কোনো অঙ্গীকার করলে, কাউকে কোনো কথা দিলে বা লিখিত চুক্তি করলে তা পালন করার নাম ওয়াদা। যাপিত জীবনে মানুষ মানুষের সাথে বিভিন্ন রকম ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এই ওয়াদা পালন করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও ঈমানের অঙ্গ। সংসার ও সমাজ জীবনে ওয়াদা রক্ষাকারীরা মানুষের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য। সবাই ওয়াদা পালনকারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন। ওয়াদা রক্ষা করা আল্লাহর একটা গুণও বটে। ইসলামী বিধানে কারও কাছে কোনো বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হলে তা পালন করা যেমন ওয়াদা, ঠিক একইভাবে আল্লাহ যা কিছু নির্দেশ দিয়েছেন এবং যেসব কাজ নিষেধ করেছেন তার সবই ওয়াদার অন্তর্ভুক্ত। কেননা এসব পালনে মুমিনরা আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ। ওয়াদা পালনের তাগিদ দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা চুক্তিসমূহ পূরণ কর। (মায়েদা-১) অন্যত্র বলা হয়েছে, তোমরা প্রতিশ্রুতি পূরণ কর, কেননা প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (বনি ইসরাইল-৩৪)
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: পৃথিবীতে ওয়াদা পালনের এক আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যেকোনো ধর্মে ওয়াদা পালনের গুরুত্ব রয়েছে। ইসলামে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। ইসলামে ওয়াদা ভঙ্গকারীকে মুনাফিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাদের জন্য পরকালে রয়েছে কঠোর শাস্তি। ওয়াদা ভঙ্গ করা মারাত্মক অপরাধ।
ওয়াদা পালনের প্রতি জোরালো তাগিদ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তোমরা ওয়াদা পালন করবে, ওয়াদা সম্পর্কে তোমাদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হবে’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩৪)। ওয়াদা রক্ষা করার সামর্থ্য থাকলে এবং তা পালন করতে ধর্মীয় কোনো বাধা না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা রক্ষা করা ওয়াজিব। বিশেষ কোনো যৌক্তিক কারণে ওয়াদা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, যাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে বিনয়ের সাথে নিজের অপারগতা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়াদা পালনকারী। তিনি তার উম্মতদের এ ব্যাপারে শিক্ষা দিয়েছেন। বুখারি শরিফের হাদিসে বর্ণিত, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার মধ্যে চারটি দোষ থাকবে সে মুনাফিক আর যার মধ্যে এর কোনো একটি দোষ থাকবে সেও মুনাফিক- যতক্ষণ সে তা বর্জন না করে। ১. যখন কথা বলে তখন মিথ্যা বলে, ২. তার কাছে আমানত রাখলে খিয়ানত করে, ৩. কোনো ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, ৪. কারও সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়লে সীমা লঙ্ঘন করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, ‘মুমিনদের জন্য ওয়াদা ঋণস্বরূপ। ওয়াদা ভঙ্গ মুনাফিক আচরণের শামিল।’ কারও কাছ থেকে ঋণ নিলে সে ঋণ পরিশোধ করা যেমন অবশ্য কর্তব্য তেমন ওয়াদা করলে তা রক্ষা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে ইসলামী বিধানে।
ওয়াদা পূরণ মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে ওয়াদা ভঙ্গ অনাস্থার আবহ সৃষ্টি করে। ওয়াদা ভঙ্গকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করা হয় ইসলামে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হাশরের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য একটি করে পতাকা থাকবে। বলা হবে এ হচ্ছে অমুকের পুত্র, অমুকের বিশ্বাসঘাতকতা।’
ওয়াদা ভঙ্গ একটি কবিরা গুনাহ। হাদিস অনুযায়ী ওয়াদা ভঙ্গকারী অবস্থায় মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণের শামিল। এ কারণে ওয়াদা পালনে মুমিনদের যত্নবান হওয়া উচিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ওয়াদা পালনের তওফিক দান করুন।
ওয়াদা বা অঙ্গীকার পালন করা ভালো মানুষের প্রমাণ। জগতের সবচেয়ে ভালো মানুষ তথা নবী-রাসুলরা সর্বদা ওয়াদা পালন করতেন। ওয়াদা পালনের দিক থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তার চিরশত্রুরা পর্যন্ত তাঁকে ওয়াদার ব্যাপারে নিরাপদ মনে করত। নবুয়তের আগে তাকে আল আমিন বলে ডাকত। তার এক মহাশত্রু আবু সুফিয়ানের জবানবন্দি এর সাক্ষী। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যখন রোমের বাদশাহ হিরাক্লিয়াস মহানবী (সা.) সম্পর্কে আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, ‘এ নবী কি ওয়াদা ভঙ্গ করেন?’ তখন আবু সুফিয়ান বলেছিল, ‘না’।” (বোখারি : ৭)।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ইসমাঈল (আ.) কে ‘সাদিকাল ওয়াদি’ বা ওয়াদা পালনকারী বলে প্রশংসা করেছেন। (সূরা মরিয়ম : ৫৪)। ইবরাহিম (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর ইবরাহিম, যে ওয়াদা পালন করেছেন।’ (সূরা নজম : ৩৭)। এজন্যই পবিত্র কোরআনে মোমিনদের বিশেষ গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে ‘ওয়াদা পূর্ণকারী’ গুণটিও উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তারা যখন ওয়াদা করে, তা তারা পূর্ণ করে থাকে।’ (সূরা বাকারা : ১৭৭)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর (মোমিন তারা) যারা তাদের আমানত ও ওয়াদা রক্ষা করে।’ (সূরা মোমিনুন : ৮)। ওয়াদা পালন করা আল্লাহ তায়ালারও বিশেষ গুণ। যেমন আল কোরআনে আছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯)।
তাই মুসলমান কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারে না। এমনকি শত্রুকেও ওয়াদা দিলে তারা তা ভঙ্গ করে না। ৬ষ্ঠ হিজরিতে রাসুল (সা.) যখন মক্কাবাসীর পক্ষীয় দূত সুহাইলের সঙ্গে হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। ওই সন্ধির অন্যতম ধারা ছিল, মক্কার কোনো ব্যক্তি মুসলিম হয়ে মদিনায় গেলে তাকে মক্কায় ফেরত দিতে হবে। অতঃপর সন্ধি চলাকালে সুহাইলের ছেলে আবু জান্দাল (রা.) শিকল পরিহিত অবস্থায় এসে তাকে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রাসুল (সা.) এর কাছে আবেদন জানালে সুহাইল আপত্তি করল। তখন রাসুল (সা.) আবু জান্দালকে সান্ত্বনা দিয়ে মক্কায় থাকতে বললেন। আর বললেন, ‘আমরা সন্ধি করেছি। তাই আমরা সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করতে পারি না।’ (উসদুল গাবাহ, ইবনে হাজার : পৃ. ১১৫৩)।
ওয়াদা পালন করা একটি সামাজিক সৎগুণও বটে। এটা সত্যবাদিতার অপর নাম এবং উন্নত চরিত্রের আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য। এজন্যই পবিত্র কোরআনে ওয়াদা পালন করাকে জ্ঞানী ব্যক্তিদের গুণ বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় জ্ঞানীরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে, যারা আল্লাহর (সঙ্গে কৃত) ওয়াদা পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না।’ (সূরা রাদ : ১৯, ২০)। ওয়াদা পালনকারীকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। যেমন তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ওয়াদা পূর্ণ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে তার জানা উচিত যে, আল্লাহ তায়ালা তাকওয়াবানদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৬)। পক্ষান্তরে ওয়াদা ভঙ্গকরাকে হাদিসে মোনাফেকের আলামত বলা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মোনাফেকের আলামত তিনটি। সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে এবং আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে।’ (বোখারি : ৩৩)। অন্য হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তির ওয়াদার ঠিক নেই, তার ধার্মিকতার ঠিক নেই।’ (সহিহ ইবনু হিব্বান : ১৯৪)।
আমরা পৃথিবীতে আসার আগে আমাদের পরম সৃষ্টিকর্তার কাছে তার আদেশ-নিষেধ পালনের যে অঙ্গীকার করে এসেছি, এখন আমরা তা ভুলে গেছি। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারা অভিশাপ পাওয়ার যোগ্য এবং তাদের জন্য রয়েছে আখিরাতে নিকৃষ্ট বাসস্থান’ (সূরা রাদ, আয়াত-২৫)।
ওয়াদা ভঙ্গের পরিণাম সম্পর্কে হাদিসে আছে, কেয়ামতের দিন ওয়াদা ভঙ্গকারীর জন্য পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং বলা হবে এটি অমুকের ওয়াদা ভঙ্গের পতাকা। (বোখারি : ৫৮২৩)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কেয়ামতের দিনে আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। তন্মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হলো, যে আমাকে সাক্ষী রেখে ওয়াদা করে অতঃপর তা ভঙ্গ করে।’ (বোখারি : ২১১৪)। ওয়াদা ভঙ্গের আরেকটি পরিণাম হলো আল্লাহর লানতপ্রাপ্তি এবং অন্তর শক্ত হয়ে যাওয়া। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(আর বনি ইসরাইলের) ওয়াদা ভঙ্গের কারণে আমি তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছি এবং তাদের অন্তরকে শক্ত করে দিয়েছি।’ (সূরা মায়েদা : ১৩)।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে ওয়াদা পালন করার তৌফিক দান করুন আল্লাহুম্মা আমিন।
EDITOR & PUBLISHER :
DR. ARIF AHMED MOMTAZ RIFA
MOBILE : 01715110022
PHONE : 0821 716229
OFFICE : SHUVECHCHA-191
MIAH FAZIL CHIST R/A
AMBAKHANA WEST
SYLHET-3100
(Beside Miah Fazil Chist Jame Masjid & opposite to Rainbow Guest House).
E-mail : sylhetsangbad24@gmail.com
Hello : 01710-809595
Design and developed by M-W-D