নতুন কমিটি নিয়ে বিএনপিতে তুষের আগুন

প্রকাশিত: ১২:১৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৭, ২০১৬

ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে ক্ষোভ-হতাশা সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে। কারণ ৫০২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে ‘জাতীয় নেতা’র ভাবমূর্তি রয়েছে এমন অনেককেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া সক্রিয় ও মাঠের অনেক নেতাকে অন্তর্ভুক্ত না করা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বলা হচ্ছে, দলের জন্য অপরিহার্য নেতাদের উপদেষ্টা কমিটিতে রাখায় বিএনপির রাজনীতি স্থবির হয়ে পড়বে। এরই মধ্যে দুই নেতা পদত্যাগ করেছেন। আবারো অনেকে পদত্যাগের চিন্তা-ভাবনা করছেন। সব মিলে এখন তুষের আগুনে জ্বলছে বিএনপি।

তবে এই ঘোষিত কমিটি নিয়ে বেশির ভাগ নেতাকর্মী অভিযোগের আঙুল তুলছে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের দিকে। কারণ সাম্প্রতিককালে এ দুজনই খালেদা জিয়ার কাছাকাছি ছিলেন। অন্য কোনো নেতা, এমনকি বিএনপির মহাসচিবও কমিটি গঠনের কাজে অংশ নিতে পারেননি বলে জানা গেছে।

এদিকে ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করেছেন মোসাদ্দেক আলী ফালু; যিনি সর্বশেষ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। ঘোষিত কমিটিতে যথাযথ পদ না পেয়ে পদত্যাগ করেছেন সাবেক সহদপ্তর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীমও।

ঘোষিত কমিটি নিয়ে সাবেক মহিলা ছাত্রনেতারাও ফুঁসছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে টক শো করে খ্যাতি লাভ করা সাবেক এমপি নিলোফার চৌধুরী মনি যেকোনো দিন বিএনপি থেকে পদত্যাগ করতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে।

ঘোষিত তালিকায় স্থায়ী কমিটির ১৭ জন, ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে ৭৩ জন এবং নির্বাহী কমিটিতে মোট ৪৯৮ জনের নাম রয়েছে। স্থায়ী কমিটিতে নতুন মুখ আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমেদ আর নির্বাহী কমিটিতে নতুন মুখ ১১৩।

অভিযোগ উঠছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসায় সার্বক্ষণিক বসবাসকারী তার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের পছন্দের লোকজনই ঘোষিত কমিটিতে প্রধান্য পেয়েছেন। কারণ অন্য কোনো সিনিয়র নেতা, এমনকি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কমিটি সম্পর্কে আগেভাগে কিছুই জানতেন না।

নেতাকর্মীরা মনে করে, বাইরে থেকে রিজভীর পরামর্শ আর ঘরে শিমুলের সহায়তা—এ দুয়ে মিলেই কমিটি হয়েছে। যেখানে তাদের বিরোধী এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সমর্থক বলে পরিচিত নেতাদের কোণঠাসা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, ফখরুল যাতে দলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন।

সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকে তার ইচ্ছায় দপ্তর সম্পাদকের পদ আবারো দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তিনি যাতে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন না হন এ জন্য তার সমর্থক বলে পরিচিতদের দপ্তরে পদায়ন করা হয়েছে। আর বিরোধীদের করা হয়েছে বিতাড়িত।

দপ্তরে আগের কমিটির তাইফুল ইসলাম টিপুকে রাখার পাশাপাশি সহদপ্তর সম্পাদক পদে বেলাল হোসেন এবং মুনির হোসেনকে পদায়ন করা হয়েছে। তারা তিনজনই রিজভী আহমেদের ঘনিষ্ঠ। পক্ষান্তরে রিজভী ও শিমুলের অপছন্দের শামিমুর রহমান শামীম এবং আবদুল লতিফ জনিকে দপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে এরই মধ্যে শামীম সহপ্রচার সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। শনিবার বিকেলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল বরাবর তিনি এ-সংক্রান্ত পদত্যাগপত্র জমা দেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দপ্তরে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো রিজভীর। শুধু তাই নয়, গত কাউন্সিলে গঠনতন্ত্রে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি সংযোজিত হলেও এ ঘটনায় তাও অকার্যকর হয়ে পড়ল। শামীমুর রহমান শামীম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাত বছর নিষ্ঠার সঙ্গে সহদপ্তরের দায়িত্ব পালন করেছি। ২৩টি মামলা রয়েছে আমার বিরুদ্ধে। ছয় মাস জেল খেটেছি। এর পুরস্কার হিসেবে পদাবনতি পেলাম। ফলে কমিটি থেকে নাম প্রত্যাহারের জন্য চিঠি দিয়েছি।’

জানা গেছে, ঘোষিত কমিটির ব্যাপারে দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের ন্যূনতম কোনো ধারণা ছিল না। কমিটি ঘোষণার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ফখরুলও জানতেন না কমিটিতে কী আছে! শনিবার সকাল ৯টায় তার উত্তরার বাসায় মাসুদ নামের গুলশান কার্যালয়ের এক কর্মচারী কমিটি পৌঁছে দিলে ১১টায় ফখরুল সংবাদ সম্মেলন ডেকে তা প্রকাশ করেন।

স্থায়ী কমিটির তালিকা দেখেও বিস্মিত হয়েছেন বিএনপির বেশির ভাগ সিনিয়র নেতা। কারণ ওই কমিটিতে জাতীয় নেতা হওয়ার মতো ভাবমূর্তি রয়েছে, আলোচনায় থাকা এমন অনেককেই বাদ দেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন এম মোর্শেদ খান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, মিজানুর রহমান মিনু, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সেলিমা রহমান।

ঘোষিত তালিকায় তাদের বেশির ভাগকে ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা উপদেষ্টা পদ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর ঘোষিত কমিটিতেও জুনিয়রদের স্থায়ী কমিটিতে পদায়ন করে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। ফলে তারা এরপর আর সক্রিরাজনীতি করবেন কি না, এ নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে।

কমিটি ঘোষণার পর আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব,) হাাফিজ উদ্দিন আহমদ ও ইকবাল হাসান মাহমুদসহ অনেকের সঙ্গে কথা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা সবাই বলেন, ‘নো কমেন্ট’। তবে নোমান জানান, কমিটি ঘোষণার পর সকাল থেকে দলের অনেক নেতাকর্মী ফোন করে তাদের হতাশার কথা জানিয়েছে।

আরেক নেতা বলেন, ‘কোনো মন্তব্য করব না; নীরব হয়ে যাব।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক নেতা বলেন, ‘কী করব? রাজনীতি করব না।

সূত্র মতে, নোমানসহ বাদ পড়া নেতাদের পাশাপাশি স্থায়ী কমিটির প্রবীণ নেতারাও ঘোষিত কমিটি নিয়ে হতাশা জানিয়ে একই ধরনের কথা বলেন। কারণ দলীয় রাজনীতিতে খোকা, নোমান, হাফিজ ও টুকুর জুনিয়র অনেককেই ইতিমধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। ফলে এ নিয়ে তারা আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। আর নতুন তালিকা দেখে তারা আরো বিরক্ত হয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে তারা কিছু বলবেন না। তবে আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবেন। প্রয়োজন হলে রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন বলে কেউ কেউ জানান। দু-একজন আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আবার অনেকে এমনও বলেন যে ঘোষিত কমিটির কারণে ভবিষ্যতে বিএনপিতে ভাঙনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গেল। এখন হয়তো কিছুই ঘটবে না। তবে দেশে অন্য কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে সংক্ষুব্ধ নেতারা তখন আর খালেদা জিয়ার দিকে ফিরে তাকাবেন না। বরং দল ছেড়ে চলে যাবেন।

১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ তালিকায় নতুন স্থান পেয়েছেন আগের কমিটির উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং এ মুহূর্তে ভারতে অবস্থানকারী আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ।

এদের মধ্যে খসরু স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পাবেন এমন আলোচনা আগে থেকেই ছিল। তবে সালাহউদ্দিনকে অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। কোন বিবেচনায় তাকে স্থায়ী কমিটিতে নেওয়া হলো তা নিয়ে দলের মধ্যে এখন নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, তিনি তারেকের লোক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আবার কারো কারো মতে, গত বছরের ৫ জানুয়ারির আন্দোলনে অনেক ‘ঝুঁকি’ নেওয়ার জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

কিন্তু বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি সাধারণত দলটির জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বকারী কাঠামো বলে বিবেচিত। সেই বিবেচনায় সালাহউদ্দিনের বদলে চট্টগ্রাম থেকে নোমান বা ঢাকা বিভাগের শাহ মোয়াজ্জেম অথবা সাদেক হোসেন খোকার ওই পদে যাওয়ার যোগ্যতা বেশি ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম বা ঢাকায় সালাহউদ্দিনকে কেউ কোনো দিন মিছিল-মিটিংয়ে দেখেছেন কি না সে আলোচনা এখন উঠছে। পাশাপাশি খসরু ও সালাহউদ্দিন স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নোমান নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে।

যদিও সরকারবিরোধী আন্দোলনে সালাহউদ্দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় পাহারা দিয়েছেন বলে কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন। তবে ওই দায়িত্ব শামসুজ্জামান দুদু, ড. আসাদুজ্জামান রিপনসহ আরো অনেকেই বিভিন্ন সময়ে পালন করেছেন। সে হিসেবে তাদের কোনো প্রাপ্তি নেই। দুদুকে ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে। আর রিপনকে বিশেষ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যে দায়িত্বে একসময় তার রাজনৈতিক কর্মী নাদিম মোস্তফাসহ আরো অনেকে ছিলেন।

স্থায়ী কমিটিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ আগের ১৫ জনকে স্বপদে রাখা হয়েছে। অসুস্থতার কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে এম শামসুল ইসলাম ও সারোয়ারী রহমানকে। ক্রম অনুসারে সালাহউদ্দিনকে সর্বকনিষ্ঠ অর্থাৎ ১৯ নম্বর সদস্য করা হয়েছে। তবে বাদ রাখা হয়েছে ১৭ ও ১৮ নম্বর সদস্যের নাম ঘোষণা। মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন, এ দুজনের নাম পরে প্রকাশ করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই ওই শূন্য পদ পূরণ করতে পারেননি খালেদা জিয়া। তবে নেতারা ধরে নিয়েছেন, পদ লাভে আগ্রহী ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্য থেকেই ওই পদ পূরণ করা হবে। স্থায়ী কমিটিতে আসতে আগ্রহী নেতাদের প্রায় সবাইকে ঘোষিত কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানের তালিকায় রাখা হয়েছে।

ক্রম অনুসারে স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন,  ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান, আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপরে রাখা হয়েছে আমীর খসরু ও সালাহউদ্দিন আহমেদকে।

এদিকে সক্রিয় বেশ কয়েকজনকে উপদেষ্টা পরিষদে রাখায় বিএনপির রাজনীতি স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই আলোচনা শুরু হয়েছে, চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন আবদুল্লাহ আল নোমান। এ ছাড়া কেউ পছন্দ করুক আর নাই করুক; বিএনপির রাজনীতিতে আমানউল্লাহ আমান ফ্যাক্টর বলে অনেকে মনে করেন। তাকে উপদেষ্টা করায় অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

বলা হচ্ছে, রাজশাহীর মিজানুর রহমান মিনুকে উপদেষ্টা করায় দলের ক্ষতি হবে। একই কারণে ঝিনাইদহের মশিউর রহমান, লক্ষ্মীপুরের আবুল খায়ের ভূঁইয়া, নোয়াখালীর জয়নুল আবদিন ফারুক ও ভিপি জয়নাল, কুমিল্লার মনিরুল হক চৌধুরী, বগুড়ার হেলালুজ্জামান তালুকদার, ঢাকা মহানগরীর আবদুস সালামসহ অনেকেই স্ব-স্ব এলাকায় সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নেতা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু উপদেষ্টা করায় তারা সবাই এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন বলে বিএনপিতে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে।

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট