২৮শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:৫২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৪
সিলেট বিভাগের ৫ ক্যাটাগরীতে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ ৫ জন জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সিলেটের উদ্যোগে তৃণমূলের সংগ্রামী নারীদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর জীবনযুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রমের ধরাবাহিকতায় সিলেটে বিভাগীয় পর্যায়ে নির্বাচিত ৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০২৩ এর সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান গত ২০ ফেব্রুয়ারি-২০২৪ মঙ্গলবার সকালে নগরীর পূর্ব শাহী ঈদগাহস্থ জেলা শিল্পকল্পা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ঢাকার মহাপরিচালক (গ্রেড-১) কেয়া খান শ্রেষ্ঠ ৫ জয়িতা অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী সিলেটের আছমা কামালী শান্তা, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী সিলেটের অধ্যাপক ডাঃ শামসুন নাহার বেগম, সফল জননী মৌলভীবাজারের কমলী রবিদাশ, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুন জীবন শুরু করেছেন যে নারী হবিগঞ্জের নাজমা আক্তার, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী হবিগঞ্জের স্বপ্না রাণী দেব বর্মা-কে উত্তরীয়, ক্রেস্ট, সম্মাননা চেক ও সনদপত্র প্রদান করেন।
সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ জয়িতাদের সাফল্য অর্জনের গল্প :
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা : আছমা কামালী শান্তা ১৯৭৫ সালের ১৯ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের ফুলাবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৯৩ সালে তিনি নানা রকম প্রতিকুলতার মধ্যদিয়ে তমিজউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। আছমা কামালীর বড় ছেলে এমসি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশ করেছে। তার দুই মেয়ে উইমেন্স সেন্ট্রাল কলেজে পড়াশুনা করছে এবং ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে।
আছমা কামালী শান্তার ছোটবেলা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল। এইচএসসি পাশ করার পর পার্লারের কাজ শেখার জন্য তিনি পরিবারের কাছ থেকে অনুমতি চাইলে পরিবার তাকে কঠিন নিষেধাজ্ঞা দেয়। চতুর দিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু করলে তাকে বিয়ে দেয়ার সিন্ধান্ত নেয় পরিবার। এক পর্যায়ে তিনি পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বড় বোনের বাসায় চলে যান। বড় বোনকে সবকিছু খুলে বলেন, বড়বোন আংটি বিক্রি করে কিছু টাকা দিয়ে আছমা কামালীকে পার্লারের কাজ শুরু করেন। তিনি পার্লারের ভ্রু প্লাক করেই দৈনিক প্রায় ৫০০ টাকা করে আয় করেন। এভাবে তার স্বপ্নগুলো বাড়তে থাকে। আয়ের টাকা জমিয়ে তিনি মুলধন ৫০০০ টাকা দিয়ে তার স্বপ্নের যুদ্ধ শুরু করেন। ছোট দোকান খোলার আশায় মানুষের দ্বারে দ্বারে তিনি ঘুরতে থাকেন। পার্লারের ব্যবসা খুব খারাপ বলে তাকে কেউ দোকান ভাড়া দিতে আগ্রহী নয়। অনেক কষ্টে একটা দোকন খুলেন; কিন্তু পাড়ার মুরব্বিরা তার দোকানটি ভেঙে দেয়। তবু তিনি থেমে যাননি। তার বোন আরেকটি দোকানের সন্ধান দেয়। সেখানেও ইউপি চেয়ারম্যান সহ স্থানীয় মানুষ বিভিন্ন প্রতিকুল অবস্থার সৃষ্টি করে। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরের সহযোগিতা নিয়ে সেই পার্লারের উদ্বোধন করেন। স্বাবলম্বী হওয়ার নেশায় তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন।
১৯৯৬ সালের পর দেশ বিদেশে বিউটিফিকেশনের উপর ট্রেনিং করেন এবং ব্র্যাকের সাথে বিউটিফিকেশনের উপর কাজ করে যাচ্ছেন। তার অঙ্গরুপা বিউটি পার্লার ইস্পা এন্ড বুটিকস থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে নিজের পার্লারে দিতে সক্ষম হয়েছেন অনেকেই। এখনো উদ্যোক্তা তৈরির কাজ তার অব্যাহত হয়েছে। আছমা কামালী শান্তা নিজ অর্থায়নে সেলাই মেশিন কিনে উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। তার প্রতিষ্ঠানে ১৫ জন মহিলাকর্মী চাকরি করে তাদের পরিবারে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করতে পারছে।
আছমা কামালী শান্তা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে এককভাবে স্বাবলম্বী হয়ে এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় আজ তিনি অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী জয়িতা।
শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা : অধ্যাপক ডাঃ শামসুন্নাহার বেগম হেনা ১৯৫৮ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ৫নং বুধবারীবাজার ইউনিয়নের চন্দরপুর গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ডাঃ শামসুন্নাহার বেগম হেনা তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সরকারি ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার এবং মাতা ছিলেন একজন গৃহিনী। তাঁর স্বামীও একজন প্রোতিথযশা চিকিৎসক। তিনি দুই সন্তানের গর্বিত জননী। ছেলে ও মেয়ে দু’জনই চিকিৎসক এবং মেডিসিন বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহন করছেন।
ছোটবেলা থেকে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তৎকালীন সময়ে গ্রামে মহিলা চিকিৎসকের অভাব ছিল। তাই ভবিষ্যতে চিকিৎসা সেবাকেই তিনি পেশা হিসেবে লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। তবে সিলেটের মানুষ কিছুটা রক্ষণশীল হওয়ার কারণে অনেক বাঁধা পেরিয়ে তাকে এ পথে হাটতে হয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভাল ফলাফল করে ১৯৭৫ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পান। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের ফলে ১৯৮১ সালে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস পাস করেন। তিনি ১৯৮৮ সালে একই বিষয়ে এফ.সি.পি.এস. ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সেবার মানসিকতা নিয়ে সিলেট মেডিকেল কলেজে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদ লাভ করেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে চাকুরী জীবন সমাপ্ত করে ২০১৬ সালে অবসর গ্রহন করেন।
বর্তমানে তিনি সরকারি-বেসরকারী পর্যায়ে গাইনি বিষয়ে শিক্ষকতা এবং প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার পাশাপাশি সিলেটের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
ফিষ্টুলা নারীর জীবনে অভিশাপ স্বরুপ। বাংলাদেশে প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার নারী। সমাজের নিম্ন আয়ের ও শিক্ষার হার কম থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই অসুস্থতার প্রকোপ বেশি। বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ এবং সিলেটের দুটি উপজেলায় নারীর ওপর জরিপ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার তথ্য সমন্বয় করে গবেষকেরা একথা বলছেন। শুধু দেশেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে সুখ্যাতি নয়, বিদেশ থেকেও তিনি পুরষ্কার লাভ করেছেন। তাঁর চিকিৎসা বিষয়ক ৩৫টি গবেষণাপত্র আর্ন্তজাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ডাঃ শামসুন্নাহার বেগম হেনা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তখনকার সময়ে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে থেমে না গিয়ে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় আজ তিনি শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী জয়িতা।
সফল জননীর কৃতিত্ব অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা : কমলী রবিদাশ মৌলভীবাজার জেলার শমশের নগর চা-বাগানের ফাঁড়ি কানিহাটি চা-বাগানের এক চা-শ্রমিক পরিবারে জন্ম। তিনি গতানুগতিক ভাবেই একজন চা শ্রমিক। অবহেলিত, অভুক্ত, নিষ্পেষিত, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত, ছোট বয়সের এক নির্ধারিত জীবনে বন্দিনী হয়েই শৈশব, কৈশোরকাল একই নিয়মে, একই বৃত্তে অতিবাহিত করেছেন। চারিদিকে শুধুই অন্ধকার। শুধুই শূন্যতা। শুধুই অভাব। বিয়ের বয়স না হওয়ার আগেই তাকে আরেক হত দরিদ্র চা শ্রমিকের সাথে বিয়ে দেয়া হয়।
তার স্বামী বাংলোর বাবুর্চি ছিলেন। স্বামীর আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না, তাই প্রায় সময়ই স্বামীর সংসারে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। বাচ্চা যখন পেটে, তখন স্বামী আরো খারাপ ব্যবহার করতো। বাগানের হাসপাতালের মহিলা ডাক্তারের কাছে দেখাতে গেলে ডাক্তার তার অবস্থা দেখে এবং সব শোনে তাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে তার বাবার বাড়িতে (শ্রীমঙ্গল) পাঠিয়ে দেন। সেখানেই তার সন্তান সন্তোষ এর জন্ম হয়। ভালো খেতে না পাওয়ায় বাচ্চাও দুধ পেত না। তাই সাগুদানা দুধের মত পাতলা করে ছেলেকে খাওয়াতেন।
১৯৯৬ সালে ছেলের বয়স যখন ৬ মাস তখন তার স্বামী মারা যান। সন্তানকে মানুষ করতে তিনি সংসারের হাল ধরেন। বিয়ের দুই/তিন বছর পর থেকেই বাগানের কাজে করতে, তখন মজুরী ছিল দৈনিক ১৮ টাকা। এক বেলা খেলে অন্য বেলা খাবার থাকত না। ছেলের এবং নিজের ভরণপোষণ করতে তাকে অনেক ধরণের কাজই করতে হয়েছে। পেটের দায়ে বেশী টাকা রোজগার করতে মাটি কাটার কাজও করেছেন। ২০০-৩০০ টাকা রোজ পেতেন। ছড়াগাঙ্গ থেকে বালু তুলার কাজও করেছেন। বালুর কাজ শেষ করে আসতে আসতে রাত ৭/৮টা বেজে যেত। অর্থের অভাবে নিজে রুটি খেতেন আর বাচ্চাকে ভাত খাওয়াতেন। পরনের কাপড় জায়গায় জায়গায় ছেড়া থাকত, পরার উপায় থাকতো না। জোড়াতালি দিয়ে কোনমতে প্যাচাইয়া পরতেন। ছেলেকে পড়ালেখা করানো ও বড় করার জন্য তিনি অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন।
২০০৭ সালের সকালের দিকে, তখন তার ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। তার মজুরি তখন ৮৮টাকা। তিনি বাজার থেকে ছেলেকে দিয়ে ৫ কেজি সরকারি চাল ৬০ টাকায় ক্রয় করেন। সেই মোটা চালের কথা আজও ভুলতে পারেননি তিনি। সকালে ছেলে স্কুলে যাওয়ার সময় ভাজা চাল ও লাল চা দিতেন টিফিন খাওয়ার জন্য। মা ছেলে দুজনে আটার রুটি চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে সকালের নাস্তা করতেন। দুপুরে কোন কোন দিন থাকত শুধু পিয়াজ, শুকনো ভাত, তেল আর লবণ। তাই দিয়ে মেখে খেতেন। রাত্রেও কোন কোন দিন কোন তরকারিই থাকত না। ২০০৭ সালের ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে ৫ বছরের জন্যে ফ্রী তে পড়ালেখার জন্য সুযোগ পান তার ছেলে।
২০১৩ সালে বিএফ শাহীন কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করান ছেলেকে। তখন তার হাজিরা ছিলো ১০২ টাকা। এই সময়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে কিস্তি টাকা তুলে তার ভর্তি, ড্রেস ও বই-খাতার টাকা দেন। ছেলে টিউশনির টাকা দিয়ে কলেজের ১০২০ টাকা মাসিক বেতন দিত। কুপি বাতি দিয়ে বাসায় পড়তে হত তার ছেলেকে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর শাহীন কলেজের ফরম ফিলাপ শুরু হয়, বোর্ড পরীক্ষার জন্য। তিনি একজন শিক্ষকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ছেলে ফরম ফিলাপ করেন। সেই সময় তার কাছে মাত্র ৫০ টাকা ছাড়া আর কিছুই বাসায় ছিলো না।
২০১৫ সালের মে মাসে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার লক্ষ্যে কোচিং এর জন্যে ছেলেকে সিলেটে পাঠান। ভার্সিটি কোচিং এর ফি, থাকা খাওয়ার জন্যে তিনি ২৫,০০০টাকা ঋণ নেন গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে। খেয়ে, না খেয়ে তিনি কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন। মায়ের কষ্টের উপার্জন ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার শক্তি যোগিয়েছে।
ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য সুযোগ পায়; কিন্তু ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর মত টাকা ছিল না। তাই সমাজের লোক, বিত্তবান ব্যক্তি, সংগঠন তাকে চাঁদা তুলে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার খরচ তার ছেলে টিউশনি করেই চালিয়েছে। কমলী রবিদাশের ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে মৌলভীবাজার জেলার মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পাবলিক রিলেশনসিপ অফিসার হিসেবে কর্মরত।
কমলী রবিদাশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট, চা-শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি ও তাদের ছেলেমেয়ে যারা শিক্ষিত হয়েছে তাদের চাকুরী নিশ্চিত করার অনুরোধ জানান। জয়িতা নির্বাচক কমিটির যারা তাকে তার কষ্টের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ।
কমলী রবিদাশ নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও স্বামী ছাড়াই জীবনের সব শখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করায় তিনি সফল জননী শ্রেষ্ঠ নারী জয়িতা।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুন জীবন শুরু করেছেন যে নারী হবিগঞ্জের নাজমা আক্তার : অভাব-অনটন, অল্প বয়সে বিয়ের পীড়িতে বসা, পদে পদে বাধা-বিপত্তি ও শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে হার না মেনে জীবন সংগ্রামে বিজয়ী এক নারী নাজমা আক্তার। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পৈল গ্রামে হত-দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সহায় সম্পদ বলতে কিছুই ছিলনা তাদের। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন নাজমা আক্তারের পিতা সমর আলী। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে নাজমা আক্তার সবার বড়। অভাবের সংসারে মেয়ে সন্তানকে অনেকটা পরিবারের বোঝা বলে মনে করা হয়। তাই মাত্র ১৬ বছর বয়সে নাজমা আক্তারকে তার বাবা বিয়ে দেন। বাল্য বিবাহের শিকার নাজমা আক্তারের স্বামীর বাড়ি যাওয়ার এক মাস পরই করুণ ইতিহাস শুরু হয়।
স্বামীর আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিলনা। বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক এনে দেয়ার জন্য নাজমা আক্তারের উপর নির্যাতন শুরু করেন তার স্বামী। কিন্তু বাবার সে সামর্থ্য না থাকায় যৌতুক এনে দেয়া সম্ভব ছিলনা। ফলে নির্যাতন সহ্য করে স্বামীর সংসার করতে থাকেন নাজমা। এরই মধ্যে তিনি এক সন্তানের মা হন। কিন্তু স্বামী তার সন্তানের ভরন-পোষণ দূরের কথা কোন খোঁজ-খবরই রাখেতেন না। এমতাবস্থায় তিনি ধার-দেনা করে একটি সেলাই মেশিন কিনে কাজ শুরু করেন। যা আয় হত সেই আয় দিয়েই সন্তানের ভরন-পোষণ চালান। নাজমার স্বামী তাকে কোন কিছু না জানিয়ে সেলাই মেশিনটি বিক্রি করে। এর প্রতিবাদ করার সাহস তার ছিলনা। উপায়ান্তর না দেখে মানুষের বাসায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন নাজমা। এভাবে দুঃখ কষ্ট করে জীবন চলতে থাকে। ২ বছর পর তিনি আবারো অন্তঃস্বত্ত্বা হন। একদিন রাতে তার স্বামী বাবার বাড়ি থেকে ৫০ হাজার টাকা এনে দেয়ার জন্য নাজমাকে চাপ সৃষ্টি করেন। এতে তিনি অপরাগতা জানালে মধ্য রাতেই সন্তানসহ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন স্বামী। আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে। কিন্তু বাবার আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। একদিকে শিশু সন্তান অপরদিকে অন্ত:স্বত্ত্বা, কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না নাজমা। শেষ পর্যন্ত একটি দর্জি দোকানে অসুস্থ শরীর নিয়েই সেলাই কাজ শুরু করেন। কিন্তু এই আয় দিয়ে চলা সম্ভব ছিল না। এমতাবস্থায় নাট্যকর্মীর সহায়তায় ব্র্যাক নাট্যদলে যোগ দেন। সেখান থেকে কিছু কিছু করে অর্থ সঞ্চয় করে একটি সেলাই মেশিন কিনে নিজেই পুনরায় সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর সাথেও সময়ে সময়ে কাজ করেন। সব মিলিয়ে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে নিজস্ব বাড়ির ৩ শতক জায়গা কিনেন। এভাবে পরিশ্রম করে তিনি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। বর্তমানে তার বড় মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং ছোট মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে।
সকল সমস্যাকে পিছনে ফেলে একা সামনে এগিয়ে যাওয়া শিখেছেন। মেয়েদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাচ্ছেন। নাজমা আক্তার ভাবেন তিনি নারী, তিনি সাহসী, তিনি অপরাজিতা। তাই তিনি শ্রেষ্ঠ নারী জয়িতা।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী : স্বপ্না রাণী দেব বর্মা পাহাড় ও টিলা ঘেরা প্রত্যন্ত এলাকায় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছেন। তিনি ১৯৭৩ সালের ২৪ মার্চ মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ডলুছড়া গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাধানাথ দেব বর্মা ও অঞ্জলী দেব বর্মার মেয়ে। রাধানাথ দেব বর্মার ৮ সন্তানের মধ্যে স্বপ্না রাণী দেব বর্মাই একমাত্র কন্যা সন্তান। এতবড় পরিবারে জন্ম নেয়া স্বপ্না রানী দেব বর্মা আর্থিক অনটনের কারনে লেখাপড়া বেশীদূর এগুতে পারেননি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর তাকে ইতি টানতে হয়েছে। ২০০০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ জেলাধীন বাহুবল উপজেলার কালিগজিয়া গ্রামের সেনাবাহিনীর করপোরাল ভবেশ দেব বর্মার সাথে বিয়ে হয় স্বর্প্না রানী বর্মার।
স্কুল জীবন থেকেই সমাজসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পড়ালেখাকালীন সময়েই তিনি গণশিক্ষা, কিশোর-কিশোরী বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান ও স্কুল শিক্ষা প্রকল্পে শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ডলুছড়া গ্রামে নিজস্ব কালচারাল এসোসিয়েশনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৮ বছর। তিনি স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও এনজিও কারিতাস এর সহায়তায় ঢাকা নারী মৈত্রী সংস্থা হতে ১ মাসের উল বুনন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান সুবিধাবঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নের কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে তিনি কালিগজিয়া গ্রামে ২০১৫ সালে ‘‘কালিগজিয়া আদিবাসী মহিলা সমবায় সমিতি’’ গঠন করে সমিতির সদস্যদের নিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন, ভাগ্য উন্নয়ন, সচেতনতামূলক ও জীবনদক্ষতামূলক কাজ চালিয়ে যান। এসব সদস্যদের তিনি বাহুবল উপজেলায় আইজিএ প্রকল্পের অধীনে সেলাই ও ব্লকবাটিক ট্রেডে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন স্বপ্না রানী দেব বর্মা। এছাড়া বাংলাদেশ সমবায় একাডেমী- কুমিল্লা, মৌলভীবাজার সমবায় একাডেমী, সিলেট যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে সমিতির সদস্যদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগী পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ব্লক বাটিক বিষয়ে জীবন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। স্বপ্না রানী বর্মা মহিলা এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর আর্থিক সহযোগিতায় কালিগজিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন।
স্বপ্না রানী দেব বর্মার অনুরোধে বাহুবল উপজেলা নির্বাহী অফিসার কালিগজিয়া গ্রাম পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র সমূহ চিহ্নিত করে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসককে অবহিত করেন। এরই প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক ৪০ জন নারীকে ৩ মাস ব্যাপী হাতে বোনা কাপড় তৈরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ, সময়োপযোগী ডিজাইন ও ফ্যাশন সম্পর্কীত উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকটি ধাপে জয়িতা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৪০ জন নারীকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এসব নারী বর্তমানে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এমনিভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্না রানী দেব বর্মা।
উপরোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ স্বপ্না রানী দেব বর্মা শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা লাভ করেছেন।
EDITOR & PUBLISHER :
DR. ARIF AHMED MOMTAZ RIFA
MOBILE : 01715110022
PHONE : 0821 716229
OFFICE : SHUVECHCHA-191
MIAH FAZIL CHIST R/A
AMBAKHANA WEST
SYLHET-3100
(Beside Miah Fazil Chist Jame Masjid & opposite to Rainbow Guest House).
E-mail : sylhetsangbad24@gmail.com
Hello : 01710-809595
Design and developed by M-W-D