অবশেষে মাদকের ট্রানজিট নিয়ন্ত্রণকারী সেই ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার

প্রকাশিত: ৪:১৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৮, ২০২১

অবশেষে মাদকের ট্রানজিট নিয়ন্ত্রণকারী সেই ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক পাচারের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট (টঙ্গী) নিয়ন্ত্রণ ও মাদক কারবারের অভিযোগে অবশেষে রেজাউল করিম (৩২) নামে ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার (২৮ এপ্রিল) ভোররাতে টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন স্থানীয় নোয়াগাঁওয়ের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তিনি ছাত্রলীগের টঙ্গী সরকারি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক পদে আছেন। পাশাপাশি তিনি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংগঠনটির গাজীপুর মহানগরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্প্রতি আলোচিত এই ছাত্রলীগ নেতার কাছে এক লাখ পিচ ইয়াবা ট্যাবলেট মজুদ থাকা সংক্রান্ত তার ফোনালাপের একটি রেকর্ড ফাঁস হলে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। টঙ্গীর চিহ্নিত এক মাদক কারবারি সাঈদা বেগমের সঙ্গে তার আলোচিত ফোনালাপের রেকর্ডটি গত ১৭ এপ্রিল মিডিয়ায় হুবহু ফাঁস হয়। এরপর ওই ছাত্রলীগ নেতার চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম বেরিয়ে আসতে থাকে। যা একাধিক জাতীয় দৈনিক পত্রিকাতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। এতেই নড়েচড়ে বসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

অবশেষে বুধবার ভোররাতে সাদা পোশাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এই ছাত্রলীগ নেতাকে বাসা থেকে তুলে নেয়। এরপর প্রথমে তাকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) টঙ্গী পূর্ব থানায় নেওয়া হয়। এ সময় থানার মূল ফটক সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়। জিএমপি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘক্ষণ তাকে থানাতেই জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পরে রাত আড়াইটায় কালো জিপে করে তাকে থানা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জিএমপি দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ ইলতুৎ মিশ জানান, মাদকের সাথে সম্পৃক্ততা ও চাঁদাবাজির মামলায় রেজাউল করিমকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশ জানায়, গত ১৯ এপ্রিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি মামলা (নং-৩৭) হয়। ওই মামলায় রিমান্ডে থাকা আসামি চিহ্নিত মাদক কারবারি জাকির হোসেন ওরফে ফরিদপুন্নীর ছেলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের জানায়, তার বাসায় আরও ইয়াবা ট্যাবলেট রক্ষিত আছে।

তার স্বীকারোক্তি মতে উক্ত মাদকদ্রব্য উদ্ধারের জন্য গত মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) রাতে জিএমপি টঙ্গী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন অন্যতম প্রধান মাদক স্পট কেরানীরটেক বস্তিতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় জাকিরের বসত ঘরের আলমিরা থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।

পরে জাকির পুলিশকে জানায়, এসব ইয়াবা ট্যাবলেট ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করিম তাকে সরবরাহ করত এবং দীর্ঘ দিন যাবত রেজাউলের সরবরাহ করা ইয়াবা ট্যাবলেট সে ক্রয়-বিক্রয় করে আসছে। ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রয়ের লভ্যাংশ তারা রেজাউলের সাথে আনুপাতিক হারে ভাগ করে নিয়ে থাকে।

উক্ত ৫০০ পিচ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধারের ঘটনায় মঙ্গলবার রাতেই টঙ্গী পূর্ব থানায় ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল ও তার সহযোগীদের নামে মামলা (নং-৫০) রুজু করে পুলিশ। এরপর ওই দিন রাতেই পলাতক আসামী ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করীমকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে রেজাউলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও মাদক দ্রব্য উদ্ধার অভিযানকালে গ্রেপ্তারকৃত মাদক কারবারি জাকির হোসেনের ভাই নবীন হোসেনকে (৪০) আরও ২৯৪ পুরিয়া গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায়ও মঙ্গলবার রাতেই টঙ্গী পূর্ব থানায় আরেকটি পৃথক মামলা (নং-৫১) দায়ের করা হয়।

এ দিকে জিএমপি টঙ্গী পশ্চিম থানা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের স্থানীয় এরশাদ নগর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত একটি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়ে সংশ্লিষ্ট ঝুট ব্যবসায়ীর কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবী করেছিল রেজাউল। ওই ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। ফলে তার হুমকিতে ওই ব্যবসায়ী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রী স্বামীর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জিএমপি টঙ্গী পশ্চিম থানায় গত ১৬ মার্চ একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অবশেষে ওই অভিযোগ গত মঙ্গলবার টঙ্গী পশ্চিম থানায় এফআইআরভুক্ত হয়।

ছাত্রলীগ নেতা রেজাউলের সহযোগী মাদক কারবারি গ্রেপ্তারকৃত জাকির ও নবীন মাদকের ব্যস্ত রোড হিসেবে পরিচিত টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন আমতলী কেরানীরটেক এলাকার মৃত হামিদ হাওলাদারের ছেলে। তাদের মা জয়তুন্নেছা স্থানীয়দের কাছে ফরিদপুন্নী নামে পরিচিত এবং জাকির ও নবীনকে স্থানীয়রা ফরিদপুন্নীর ছেলে বলে পরিচিত।

কে এই রেজাউল?

রেজাউল করিমের বাবার নাম হোসেন আলী। তারা দীর্ঘ দিন যাবত টঙ্গী রেলওয়ে জংশন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন।

স্থানীয়রা জানান, রেজাউলের বাবা টঙ্গী রেলস্টেশনের গোল চক্কর ফুটপাতে বসে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতেন। চার ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট রেজাউল পূবাইল আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি ২০০৭ সালে টঙ্গী সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ার পর পড়ালেখার খরচ জোগাতে বাসের টিকিট কাউন্টারে কাজ নেন। টিকিট বিক্রির সুবাদে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যান। প্রথমে ফেনসিডিল বিক্রি করতেন তিনি।

এক পর্যায়ে স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে টঙ্গী সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি বাগিয়ে নেন। ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার পর তার মাদক ব্যবসা নির্বিঘ্ন হয়। পরবর্তীকালে ইয়াবার হোল সেলারে পরিণত হন তিনি। কক্সবাজারের মাদক মাফিয়াদের সাথেও রেজাউলের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। কক্সবাজার থেকে আনা কোটি টাকার ইয়াবার চালান নিয়ে সম্প্রতি টঙ্গীর মাদক কারবারি সাঈদা বেগমের সাথে তার ফোনালাপে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

দলীয় একটি সূত্র জানায়, সাবেক টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সফি আহমেদ সফির হাত ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করেন রেজাউল। পরে প্রভাবশালী নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে সফিকে কোণঠাসা করেন তিনি। এ জন্য দলে তিনি গুরুমারা শিষ্য হিসেবেও বেশ পরিচিত। ২০১৬ সালে মাদক বিক্রির টাকা খরচ করে টঙ্গী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন বলে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা দাবি করেন।

তার বিরুদ্ধে সাবেক টঙ্গী মডেল থানায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলাও রয়েছে। রেজাউল পাঁচ বছর আগে বিয়ে করে সন্তানের বাবাও হয়েছেন। দীর্ঘদিন যাবত ছাত্রত্ব না থাকা সত্ত্বেও তিনি এখনো ছাত্রলীগের পদ ধরে রেখেছেন।

কলেজ শাখা ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদটি বাগিয়ে নেওয়ার পর ফেনসিডিলের কারবার ছেড়ে তিনি ইয়াবার কারবার শুরু করেন। দলীয় পদ ব্যবহার করে টেকনাফ ও কক্সবাজার থেকে নিজের গাড়ি দিয়ে নির্বিঘ্নে ইয়াবার চালান নিয়ে আসারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মাত্র চার বছরের ব্যবধানে মাদকের টাকায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হন তিনি। এক পর্যায়ে ভাড়া বাসা ও ভবঘুরে জীবন ছেড়ে টঙ্গীর দত্তপাড়া হাফিজ উদ্দিন সরকার রোডে জায়গা কিনে নিজস্ব বাড়িতে উঠেন। এ ছাড়া দত্তপাড়া সাইদ মৃধা রোডে তিন কাঠা জমিতে একটি আধা পাকা বাড়িও করেছেন। উত্তরায়ও ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে জানা গেছে। পরিবহন খাতেও তার বিনিয়োগ রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।


 

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট