হেরেও নতুন ইতিহাস গড়লেন হিলারি

প্রকাশিত: ১০:৩৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৯, ২০১৬

হেরে গিয়েও বিশ্বে নতুন ইতিহাস গড়লেন হিলারি ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট পদে তিনিই প্রথম নারী প্রার্থী হন।

বিশ্বের ক্ষমতাধর এই দেশটি শাসক হিসেবে বরাবরই পুরুষকে বেছে নিয়েছে। যার প্রতিফলন দেখা গেছে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে। প্রেসিডেন্ট পদের দলীcয় মনোনয়ন সব সময়ই জুটেছে পুরুষের। এই প্রথম দেশটির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কোনো নারীকে মনোনয়ন দেয়। আর প্রথমবারের মতো নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর স্বামী হিসেবে ইতিহাসের অংশ হলেন বিল ক্লিনটন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে পরাজিত হন দেশটির সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন।

হিলারি ক্লিনটন এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

হিলারি ক্লিনটন। বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই শুধু হননি, রাজনীতিক হিসেবেও দক্ষ। বিশ্বের প্রভাবশালী এ নারীর শুরুটা হয়েছিল সাদামাটাভাবেই।

বর্তমান বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন হিলারি ক্লিনটন। পুরো নাম হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয়। আর দশজনের মতোই সাদামাটা ছিল হিলারির শৈশব। স্কুল আর কলেজের পাট চুকিয়ে আইন নিয়ে পড়তে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ওয়েলেসলি কলেজ প্যানেলে হিলারি

পার্ক রিজে প্রাথমিক বিদ্যালয় আর মাইন সাউথ হাইস্কুলে মাধ্যমিক শেষ করে ১৯৬৫ সালে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ওয়েলেসলি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন তিনি। হৈ-হুল্লোড় আর নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কেটেছে হিলারির কলেজ জীবন। কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়ে সময় কেটেছে তার। কলেজ জীবনে শিক্ষকদেরও প্রিয় ছাত্রী ছিলেন সাবেক এই মার্কিন ফার্স্ট লেডি।

রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে ১৯৬৮ সালে যোগ দেন ডেমোক্রেটিক পার্টিতে।

দীর্ঘদিনের বন্ধু বিল ক্লিনটনকে জীবনসঙ্গী করতে বিয়ের গাউন পড়েছিলেন ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৯ সালে মার্কিন রোজ ল ফার্মে প্রথম নারী আইনজীবী হিসেবে যোগ দিয়ে সেবছরই স্থান করে নেন টাইমস পত্রিকার পাতায়।

১৯৯৩ সালে বিল ক্লিনটন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে হিলারি মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিসেবে প্রবেশ করেন হোয়াইট হাউসে। এসময়ই তিনি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন। তবে এসময় ইরাক যুদ্ধের মতো বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছেন হিলারি।

২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষে মনোনয়ন চেয়ে মাঠে নামেন। তবে রাজনৈতিক সমঝোতায় নিজেকে প্রার্থীতা বাতিল করে প্রতিদ্বন্দ্বী বারাক ওবামার পক্ষেই প্রচারণা চালাতে থাকেন। নির্বাচনের পর ওবামা সরকারের পররাষ্ট্র্র্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান হিলারি।

১৯৯৫ ও ২০০০ সালে দুবার বাংলাদেশ সফর করেছেন হিলারি। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সফরে আসেন ২০১২ সালের ৫ মে। নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আছে হিলারি ক্লিনটনের।

হিলারির দাম্পত্যজীবন

স্ত্রীর এমন সাফল্যে আপ্লুত ৬৯ বছর বয়সী বিল ক্লিনটন। ফিলাডেলফিয়ায় ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সময় এই ডেমোক্র্যাট নেতা বলেন, ‘আমার জীবনে দেখা সেরা পরিবর্তনের রূপকার হলেন হিলারি।’

বিল ও হিলারির দাম্পত্য জীবন চার দশকেরও বেশি। হিলারির সঙ্গে দেখা হওয়ার দিনটির কথা স্মরণ করে বিল ক্লিনটন বলেন, ‘১৯৭১ সালের বসন্তে, এক মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। সেই মেয়েটি হিলারি।’

‘আমি আমার সেরা বন্ধুকে বিয়ে করেছি’—আবেগ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে এ কথা বলেন বিল ক্লিনটন। তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন, তখন ফার্স্ট লেডি হিসেবে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করেন হিলারি। আট বছর হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা থাকাকালে স্বামী ক্লিনটনের সংকটে স্ত্রী হিসেবে হিলারির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। বিশেষ করে বিল ক্লিনটন যখন হোয়াইট হাউসের শিক্ষানবিশ কর্মী মনিকা লিউনেস্কির সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, তখন স্ত্রী হিসেবে হিলারি তাকে ছেড়ে যাননি। পাশে থেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে সহায়তা করেন।

হিলারির প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিল ক্লিনটন বলেন, ‘হিলারি অসম্ভব স্মার্ট। অসম্ভব ব্যক্তিত্বশীল। ভালোবাসা আর আদর-যত্নে ভরিয়ে রাখা একজন মানুষ।’ তিনি আরো বলেন, ‘হিলারি সব সময় সামনে এগোনোর পক্ষে। তিনি কে, এটা বোঝানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট।’

যে কারণে হেরে গেলেন হিলারি

ইতিহাস হতে পারতো মার্কিন নির্বাচন। হতে পারতো মার্কিন ইতিহাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিলারি। অন্তত নির্বাচনের আগে সকল জরিপগুলো সেরকমই আভাস দিয়েছিলো। ইতিহাস রচিত হয়েছে। তবে সেটি হিলারির পক্ষে নয়, বহু বিতর্কিত অরাজনৈতিক ধনকুবের ট্রাম্পের পক্ষে।

হিলারি পরাজয় মেনে নিলেও বিশ্লেষকদের কাছে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন এই হার।

বিশ্লেষকরা বলছে, লাতিন ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিনদের নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য সত্ত্বেও তাদের টানতে পারেননি হিলারি।

প্রায় ৮৮ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ হিলারিকে সমর্থন করেন। সেখানে ট্রাম্পের সমর্থন ছিল ৮ শতাংশ।

যিনি বারবার বলেছেন, সব যুগে সবচেয়ে কদাকার এই কৃষ্ণাজ্ঞ সম্প্রদায়। সিএনএনের খবরে এ তথ্য জানানো হয়।

এই পার্থক্যটা ২০১২ সালে ওবামা ও রমনির মধ্যে যে পার্থক্য ছিল, তেমনটা নয়। গত প্রেসিডেন্টে নির্বাচনে বারাক ওবামা ৯৩ শতাংশ ও রমনি পেয়েছিলেন ৭ শতাংশ ভোট।

লাতিনদের কাছ থেকে পুরোপুরি সমর্থন আদায় করতে পারেননি হিলারি। ট্রাম্প লাতিনদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছিলেন।

ট্রাম্প বলেছিলেন, অবৈধ অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এ বক্তব্যের পরও রিপাবলিকান এই প্রার্থী ২৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। আর হিলারি পেয়েছেন ৬৫ শতাংশ ভোট।

একই সঙ্গে হিলারি তরুণ ভোটারদের কাছে পৌঁছাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ভোটারদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন হিলারি। ট্রাম্প পেয়েছেন ৩৭ শতাংশ। অথচ ওবামা পেয়েছিলেন ৬০ শতাংশ ভোট।

হিলারির পরাজয়ের অন্যতম আরেকটি কারণ হতে পারে, মার্কিন নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের একের পর এক বিতর্কে নির্বাচনের মাঠে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি কিনটন যখন নিশ্চিতভাবে এগিয়ে ঠিক তখনই এএফবিআই হিলারির ই-মেইল আবার তদন্তের উদ্যোগ।

নির্বাচনের আগ মুহূর্তে একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমন চমকে দেয়ার মতো উদ্যোগ হয়তো নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে বলে বিশ্লেষকদের মত। যদিও নির্বাচনের একদিন আগে এফবিআই হিলারিকে নির্দোষ ঘোষণা করেন।

হিলারির পরাজয়ের কারণ হিসেবে লিঙ্গ বৈষম্যকে ফেলে দেওয়া যায় না। আমেরিকানরা যতই আধুনিক হোক না কেন, তাদের ভেতর এখনো লিঙ্গ বৈষম্য প্রবল।

একজন নারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবে, এটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না অনেক মার্কিন নাগরিক। তাই ভোটকেন্দ্রে গিয়ে অনেক ডেমোক্রেটও ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পের পক্ষে। এটি নিঃসন্দেহে হিলারির পরাজয় তরান্বিত করেছে।

হিলারির পরাজয়ের পেছনে আরো একটি বড় কারণ ছিল তার ই-মেইল কেলেঙ্কারি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহারের অভিযোগে এফবিআইয়ের তদন্ত হিলারির নির্বাচনে ‘কলঙ্ক লেপন’ করে।

মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে দেখা যায়, পরপর তিন দফায় একই দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা দুষ্কর। ১৯৮৮ সাল থেকে কখনোই এরকম ঘটনা ঘটেনি।

গত দুই ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থীরা। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিকই এবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীকে দেখতে চেয়েছিলেন।

এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের স্লোগান ছিল ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ অর্থাৎ ‘আমেরিকাকে আবারো মহান করো’। ট্রাম্পের এই স্লোগান ২০০৮ সালের বারাক ওবামার স্লোগান ‘চেঞ্জ, উই ওয়ান্ট’ এর মতোই ভোটারদের অনুপ্রাণিত করেছে।

অনেকেই মনে করেছেন, রিপাবলিকান ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে ডেমোক্রেটিক হিলারির চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি ভাল রাখবেন। তাই তারা হিলারিকে ভোট না দিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

নির্বাচনপূর্ব জরিপে বরাবরই প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এক মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিউ ইয়র্ক টাইমসে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘এটি হিলারি জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ নির্বাচনে হিলারির জিতবেন এমনটি ধরে নিয়ে তার অনেক ভোটার হয়তো ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন না।’

শেষ পর্যন্ত সেই বিশ্লেষকের কথাই সত্য হলো। নির্বাচনে হিলারির পক্ষে যেমন ভোট পড়ার কথা ছিল তার কাছাকাছিও পড়েনি। ফ্লোরিডা, টেক্সাস, নর্থ ক্যারোলিনায় জয় পাবার কথা ছিল হিলারি ক্লিনটনের। অথচ তাকে হটিয়ে সেখানে স্পষ্ট ব্যবধানে জয় পেয়েছেন ট্রাম্প। জর্জিয়া, ওহাইও, মিশিগান, নিউ হ্যাম্পশায়ার, অ্যারিজোনা, উইসকনসিল এমনকি পেনসিলভানিয়ায়ও হিলারি তার কাঙ্ক্ষিত ভোট পাননি।

আর এসব কিছুই হোয়াইট হাউসের চাবি হিলারি ক্লিনটনের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট