রাষ্ট্রনায়ক এরদোগান বিশ্বে ‘রোলমডেল’

প্রকাশিত: ৫:৩৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০১৬

১৯৯৭ সালের কথা। সেনা অভ্যুত্থানের পর সরকারি ঘোষণায় তুরস্কে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রতিবাদে তখন তুরস্কের জনগণ ফুঁসে উঠে। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে তুরস্ক উত্তাল। সেই সময় এক বিক্ষোভে অংশ নিয়ে একটি কবিতা আবৃতি করে প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়েছিলেন রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। সে অপরাধেই তাকে ৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তাকে ১০ মাস কারা ভোগও করতে হয়েছিল।

কী ছিল সেই কবিতার ভাষা। সেদিন তিনি কবির কাব্যময়তায় আবৃতি করেন-

‘মসজিদ আমাদের ক্যান্টনমেন্ট, গম্বুজ আমাদের হেলমেট,

মিনার আমাদের বেয়োনেট এবং বিশ্বাসীরা আমাদের সৈনিক।,

মূলত এটি কোনো প্রথিতযশা কবির কবিতা বা কাব্যের অংশ নয়। এক অপরাজেয় সৈনিকের তেজস্বী উচ্চারণ। সেই অপরাজেয় সৈনিকই আজকের মহানায়ক এরদোগান।

তিনি কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছেন। সকল বাধা, প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা উপেক্ষা তার গতি এখন দুর্নিবার-দুর্বিনীত। তিনি তুর্কি জাতির মুক্তির জন্য হাতে তুলে নেন এক আলোকবর্তিকা। তার মধ্যে যে আলোর স্ফুরণ ঘটেছে, তা কি কখনো প্রতিরোধ যোগ্য? কখনোই নয়। তাই কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান এখন নায়ক থেকে মহানায়ক।

অন্যদের মত তিনি শুধু তুরস্কের রাষ্ট্রনায়কই নন, বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রনায়কদের জন্য এক রোলমডেল।

এরদোগান, পৃথিবীতে এই মুহুর্তে একটি বহুল আলোচিত। বিশেষত গত শুক্রবার রাতে ঘটে যাওয়া ব্যর্থ সেনা অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে সারা দুনিয়াতে আবারো আলোচনায় এসেছে তুরস্ক তথা এর প্রেসিডেন্ট এরদোগান। যার ডাকে লাখ লাখ দেশ প্রেমিক জনতা রাস্তায় নেমে আসে। এমনকি ট্যাঙ্কের সামনে সেনা অভ্যুত্থান রুখতে জীবন বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি অনেকে।

এভাবে জনগণের স্বতঃফুর্ত ভাবে রাতে রাস্তায় নামার ফলে ব্যর্থ হতে বাধ্য হয় কতিপয় বিদ্রোহী সেনার অভ্যুত্থান।

কে এই এরদোগান?

বর্তমান বিশ্বে তিনিই একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি পার্লামেন্ট মসজিদে মাঝে মাঝেই নামাজের ইমামতি করেন। তুরস্কের অনেক মসজিদে নামাজের ইমামতি করেছেন তিনি। তার উদ্যোগে প্রতি বছর তুরস্কে বিশ্ব কোরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এবং এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাফেজরা অংশ গ্রহণ করে থাকেন।

রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলাম, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রকে সমন্বিত করে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি রোল মডেল সৃষ্টি করেছেন তিনি। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের জনগণের ধর্মপালনের অধিকার কেড়ে নিয়ে কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামী ঐহিত্য, তাহজিব-তমুদ্দুন ও চেতনা মুছে ফেলেছিলেন।

তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাই তো এরদোগানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজেও।

বছর তিনেক আগে তুরস্কে সফরে গিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, একজন নেতা কীভাবে একইসঙ্গে ইসলামিক, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু হতে পারেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এরদোগান।

১৯৫৪ সালে তুরস্কের কাসিমপাসায় জন্মগ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা মহানায়ক। শৈশব কেটেছে কৃষ্ণসাগরের পাড়ে, অতিসাধারণভাবে। ১৩ বছর বয়সে আসেন ইস্তাম্বুলে। জীবিকার তাগিদে তিনি রাস্তায় বিক্রি করতেন লেবু, তিল ও ঝুটি। কিন্তু তিনি জীবনযুদ্ধে থেমে যাননি। চলেছেন অপ্রতিরোধ গতিতে। পড়ালেখায় মনোনিবেশ করলেন তিনি।

তিনি উচ্চশিক্ষা নিলেন ব্যবসায় প্রশাসনে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে যোগ দেন ইসলামী আন্দোলনে। তিনি দ্বীন প্রতিষ্ঠাকে জীবনোদ্দেশ্য হিসাবেই গ্রহণ করেন। খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অগ্রসেনানির ভূমিকা গ্রহণ করেন। ফলে তার জীবনের গতিধারা পাল্টাতে শুরু করে।

অনেক বাধা-প্রতিবন্ধকতা তাকে অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু তিনি তার লক্ষ্যে অবিচল-বিরামহীন। এক সময়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তার ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, মেধা, যোগ্যতা, প্রত্যুতপন্নমতিত্ব ও দূরদর্শিতার কারণে ক্রমেই মহীরূহে পরিণত হন, যা গোটা বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

তিনি অবতীর্ণ হন নির্বাচন যুদ্ধে। আসে এক সময়োচিত ও বিরোচিত বিজয়। ১৯৯৪ সালে তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। আবির্ভূত হন এক তরিৎকর্মা ও সব্যসাচী মেয়র হিসাবে। তখন ইস্তাম্বুল নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। নগরবাসীর জীবনযাত্রার ছিল খুবই নিম্নমানের।

কিন্তু এরদোগানের সোনার কাঠি-রূপোর কাঠির জাদুকরী ছোঁয়ায় সবকিছু পাল্টাতে শুরু করে। দেড় কোটি মানুষের শহর ইস্তাম্বুলে তখন তিনি যানজট, বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট ও বায়ুদূষণ রোধ করে নগরের চেহারা পাল্টে দেন। নাগরিক সেবার পরসির বৃদ্ধি করা হয়। ইস্তাম্বুল পরিণত হয় এক সর্বাধুনিক মহানগরীতে, যা বর্তমান বিশ্বের জন্য রোল মডেল।

শুরু হয় এরদোগানের জীবনের স্মরণীয় অধ্যায়। তার দীর্ঘদিনের মিত্র আব্দুল্লাহ গুল ও অন্যদের সঙ্গে মিলে ২০০১ সালে একেপি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। অতি অল্পসময়ের মধ্যেই নতুন প্রতিষ্ঠিত দলটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। দেশের মানুষ একে পার্টিকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে নেয়। ২০০২ সাল থেকে দলটি প্রতিটি নির্বাচনে জয়লাভ করে আসছে।

একে পার্টি ২০০২ সালে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে প্রথমবার ক্ষমতাসীন হয়। ২০০২ সালে একে পার্টি আসন পেয়েছিল ৩৬৩টি, ২০০৭ সালে ৩৪১, ২০১১ সালে ৩২৭ এবং ২০১৫ সালের জুন মাসের নির্বাচনে ২৫৮টি আসন। জুন মাসের নির্বাচনে সরকারের গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন না পাওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হওয়ায় নভেম্বরে নতুন নির্বাচনের আবশ্যকতা দেখা দেয়।

সেখানেও ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় একে পার্টি। অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বামপন্থী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) ২০০২ সালে ১৭৮টি, ২০০৭ সালে ১১২, ২০১১ সালে ১৩৫, ২০১৫ সালের জুনের নির্বাচনে ১৩২টি আর সর্বশেষ নভেম্বরের নির্বাচনে ১৩৪টি আসনে বিজয়ী হয়।

প্রসঙ্গত, ২০০২ সালের নির্বাচনে একে পার্টি পার্লামেন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও কারাদণ্ডের অতীত থাকায় প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি দলনেতা এরদোগান। পার্লামেন্টে নতুন আইন পাসের মাধ্যমে ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে তুরস্কের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন।

লম্বা স্লিম মধ্যবয়স্ক এরদোগান রাজনীতিতে এক ভিন্নধর্মী ইমেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার ব্যতিক্রমী চরিত্র মাধুর্য ও বিরল ব্যক্তিত্ব তাকে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছতে সাহায্য করে। তিনি বিরল প্রতিভা ও অসাধারণ সাংগঠনিক প্রজ্ঞার অধিকারী।

দৈনিক হুররিয়াত এবং আল জাজিরার দেয়া তথ্য মতে, তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার সময় প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে হত্যা করার জন্য তিনটি সামরিক হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছিল। তিনি তখন তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মারমারায় অবকাশ যাপন করছিলেন। সেখানেই তাকে হত্যা কিংবা বন্দি করার জন্য পাঠানো হয়েছিল হেলিকপ্টারগুলো।

ব্যর্থ অভ্যুত্থানের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে হুরিয়াতের খবরে বলা হয়, আর্মির ফার্স্ট কমান্ডার উমিত দান্দার শুক্রবার দিবাগত রাতে (অভ্যুত্থানের এক ঘণ্টা আগে) এরদোগানের সাথে যোগাযোগ করে অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার বিষয়টি জানাতে পেরেছিলেন। এই খবর পেয়েই এরদোগান হোটেল ত্যাগ করেছিলেন। বিদ্রোহী সৈন্যরা যখন সেখানে পৌঁছে, তার আগেই তিনি সরে পড়ে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানিয়েছিলেন।

তুরস্কের সরকারি ওয়েবসাইট টিসিসিবি.গভ.টিআর, আলজাজিরা ও ডেইলি হুররিয়াত অবলম্বনে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট