সাফল্য-ব্যর্থতার চরম সন্ধিক্ষণে বিএনপি

প্রকাশিত: ৭:৪৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২

সাফল্য-ব্যর্থতার চরম সন্ধিক্ষণে বিএনপি

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

বিএনপিকে মাঠে চায় সরকার। তবে, নিয়ন্ত্রিত পরিসরে। গৃহপালিত না হলেও কিছুটা আজ্ঞাবহ আদলে। রাজপথে বা আন্দোলনে বিএনপিকে বাধা দেয়া হবে না-প্রধানমন্ত্রীর এ ওয়াদার অংশ হিসেবে দলটি এখন প্রায় পুরোদমে আন্দোলনে। কিন্তু, মাঠে মার খাচ্ছে নিয়মিত। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ক্ষমতাসীন দল বা পুলিশের হামলার শিকার হচ্ছে। নিহতও হয়েছে কয়েকজন।


সরকারের হয়তো ধারনা ছিল বিএনপি রাজপথে নামানোর মতো কর্মীই পাবে না। যা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগ নেতারা নানান তীর্যকভাষায় বলেও ফেলেছেন। বিএনপির মরা গাঙে জোয়ার আসবে না, আন্দোলনের মাঠে হাজার পাওয়ার লাইট দিয়েও বিএনপি নেতাকর্মীদের খুঁজে পাওয়া যাবে না-এ ধরনের মন্তব্য ছিল নিয়মিত।

বাস্তবটা ওই রকম হয়নি। দলটির নেতাকর্মীরা মাঠে এভাবে তেতে উঠবে, তা ছিল ক্ষমতাসীনদের ধারনার বাইরে। এখন দমন বা নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিতে হয়েছে সরকারকে। এর মাঝে আবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ত্যাগ করেছে জামায়াতে ইসলামী। ক্ষমতাসীন দলে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নেতাদের কেউ বলছেন, বিএনপির বড় উইকেট পতন হয়ে গেছে। কেউ বলছেন, জোট ছাড়ার ঘোষণা আসলে জামায়াতের একটি চাতুরি। ভেতরে-ভেতরে দলটি বিএপির সঙ্গেই আছে। তবে, বিএনপি এ প্রশ্নে কোনো জবাব দিচ্ছে না। জামায়াত তাদের সঙ্গে আছে বা নাই কোনোটাই বলছে না।

 

 

এ রকম অবস্থার মাঝে সরকার পতনে বৃহত্তরও যুগপৎ আন্দোলনে এলডিপি, জামায়াত ও নাগরিক ঐক্য একসাথে মাঠে থাকবে বলে জানিয়েছেন, দলগুলোর নেতারা। তাও প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপির আয়োজনে আলোচনায় উপস্থিত জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক ঐক্যও এলডিপি নেতারা একই সুরে কথা বলেন। সভায় তিন দলের নেতারা কোনো রাখঢাক না রেখে বলেছেন, আন্দোলনের জন্য সমমনা দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে। নির্বাচন সামনে রেখে তাদের বোঝাপড়া তথা ঐক্য আরো বাড়বে। দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সামনে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন তারা। কর্ণেল(অব.) অলি আহমদ বলেন, বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের একটা চেষ্টা চলছে। এ-সংক্রান্ত আলোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কীভাবে আন্দোলন হবে, তার রূপরেখা যেকোনো দিন জাতির সামনে বিএনপি দেবে। সেই রূপরেখার সঙ্গে তারা একমত।

সভাটি ‘কিসের মধ্যে কী,পান্তা ভাতে ঘি’ র মতো বার্তা সরকারের জন্য। জামাতের বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়ার পর মাত্র কদিন আগে বিকল্প ধারার অধ্যাপক বি. চৌধুরী এবং এলডিপির কর্নেল ( অব.) অলির নেতৃত্বে তৃণমূল বিএনপি গঠনের গুঞ্জন উঠেছিল। সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ায় জামায়াত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়ে যাবে- এমন কানাঘুষাও ছিল। দৃশ্যত চিত্র এখন ভিন্ন। রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু থাকে না। আবার প্রকাশ্য দৃশ্যের সঙ্গে নেপথ্য মেলে না সব সময়। গোটা রাজনীতিতে এখন ওই ধাঁচের একটা পরিস্থিতিই চলছে। বিএনপির জন্য সময়টা বেশি কঠিন। দলটির নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্যের রসায়নে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের কথা চাউর হলেও নিশানা এখনো কুয়াশাচ্ছন্ন। ঐক্য গঠনের নামে চলা তোড়জোরের পরিণতিও প্রশ্নবিদ্ধ।

 যদিও আওতার অংক প্রশ্নে তারা ২০ ছাড়িয়ে গেছে। জোটের মিত্রদের বাইরে ছোট-বড় সমমনা ডান-বাম ও ইসলামী ২২টি দলের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ শেষ হয়েছে। জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলন, সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ড.রেজা কিবরিয়াও নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদ, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, মোস্তফা মোহসীন মন্টুর গণফোরাম রাজনীতিতে ম্যাটার করে। বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির বিজেপি এবং জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপের সঙ্গেও কথাবার্তা হচ্ছে। এর বাইরে সংলাপ হতে পারে শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদের সঙ্গেও।

নানান দুয়ারে বিএনপির এ বিচরণ কী ফল আনবে?-এ প্রশ্নের সঙ্গে দলটির ভবিষ্যতও সম্পৃক্ত। প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময়ে বিএনপিকে কঠিন অবস্থায় পড়তে হয়েছে। তবে, ধরন বিচারে এবারের অবস্থায় ব্যাপক ভিন্নতা।  ক্ষমতাবলয়ের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া বিএনপি এমন কোনঠাসায় আর পড়েনি। টানা ১৫-১৬ বছর কেবল ক্ষমতার বাইরেই নয়, নেতৃত্ব থেকেও না থাকার দশায় দলটি। কোন পথে গেলে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নির্বাচনে গিয়েও চরম মার খেয়েছে। তাহলে সামনে কোন ধরবে? কী করার আছে?
বিএনপির নেতৃত্বের শূন্যতা বা কাহিল দশায় নিয়মিত খোঁচা পড়ছে সরকারি দল থেকে। বার বার জানতে চাওয়া হচ্ছে, বিএনপির আগামীর নেতা কে? দলটি ক্ষমতায় গেলে কে হবেন তাদের প্রধানমন্ত্রী?

বিএনপির পক্ষ থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নাম বলায় পাল্টা খোঁচা। তারাতো কনভিক্টেড, নির্বাচনই করতে পারবেন না- এ ধরনের মন্তব্যে রাজনৈতিক ঘায়েল চলছে। তা করাই স্বাভাবিক। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দু’টি মামলায় কারাদণ্ডাদেশ নিয়ে গুলশানের বাসায় একরকম ‘বন্দি’ জীবনযাপন করছেন। শর্তসাপেক্ষে ‘সাময়িক’ মুক্ত থাকলেও রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ তার নেই। দলীয় সিদ্ধান্ত এবং গঠনতন্ত্র মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান। তিনি একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। তারওপর দেশান্তরি। সাত সমুদ্র ১৩ নদীর পাড় লন্ডনে। সেখান থেকে ওভার ফোন এবং ভিডিও বার্তায় দল চালাচ্ছেন তিনি। দেশে ফ্রন্টে আছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বলা হয়ে থাকে, এ দলের আর কোনো মহাসচিবকে এতো পরিশ্রম করতে হয়নি। সইতে হয়নি এতো চাপ।
দলটির শীর্ষ নেতাদের দাবি-৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা দিয়েছে সরকার। এসব মামলা সামলাতেই কাহিল অবস্থা নেতাকর্মীদের। কখনো পালিয়ে, কখনো আদালতে, জেলে, জামিনে কাটে তাদের বেশিরভাগ সময়। দলের ৪৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের আদালতে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়েছে। সেখান থেকে জামিন নিয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানে গেছেন জিয়াউর রহমানের কবরে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর ফুল দিতে।

এমন পরিস্থিতিতে আগামীর গন্তব্যে এগোতে হচ্ছে দলটিকে। আর গন্তব্য হয় সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করা, নইলে নির্বাচন প্রতিরোধ করা। তারওপর চেয়ার পারসন  খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন। এ অভিযাত্রায় তারা কতোটা সফল হবে এ বিষয়ে এখনই হলফ করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তাদের চলমান আন্দোলনের তীব্রতা কোন পর্যায়ে যাবে তাও অস্পষ্ট। এ সন্ধিক্ষণ কাটিয়ে ওঠা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই তাদের। আবার এর ওপরই নির্ভর করছে দলটির ভবিষ্যত।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলা পোস্ট


 সূত্র : বাংলা ভিষণ নিউজ পোর্টাল 


এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট