জামিন পেলেও মুক্তি পাচ্ছেন না মেয়ররা!

প্রকাশিত: ১২:২৯ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০১৬

মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব : দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে দফায় দফায় জামিন পেলেও বিপুল ভোটে বিএনপির মনোনীত নির্বাচিত মেয়ররা পুলিশের সাজানো ও সরকারদলীয় নেতাদের কারসাজির মামলায় মুক্তি পাচ্ছেন না। আবার জামিনে মুক্তি পেলেও মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার আগেই নতুন-পুরনো মামলায় আবারো গ্রেফতার করা হচ্ছে বিপুল জনপ্রিয় মেয়রদের। একদিকে কারাগারে নির্মম নির্যাতনে জনপ্রিয় এই নেতারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অবর্ণনীয় জীবন যাপন করছেন, অন্যদিকে ওই সিটি এলাকায় দলীয় কাউন্সিলরা মেয়রের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব নিয়ে ব্যাপক লুটপাট করায় নগরবাসীও কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সর্বশেষ গাজীপুরের মেয়র এম এ মান্নান পুলিশের ২৭টি মামলায় জামিন পেলেও এক আ’লীগ নেতার কথিত চাঁদাবাজি মামলায় তাকে আবার শ্যোন অ্যারেস্ট করা হয়। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক ও হবিগঞ্চের মেয়র জিকে গউছ সুপ্রিম কোর্টের আদেশে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দিলেও নতুন মামলায় তাদের আটক করা হয়। নির্বাচিত এসব মেয়র ছাড়াও দেশের বিভিন্ন পৌরসভা ও উপজেলার নির্বাচিত মেয়র-চেয়ারম্যানরাও পুলিশের মামলায় আটক করে বরখাস্ত করে হয়রানি করা হচ্ছে। এদিকে গতকালও মিথ্যা মামলায় আটক করা হয়েছে কলারোয়ায় বিএনপির পৌরমেয়র আক্তারুলকে। : জানা যায়, কেবল বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনপ্রিয় এসব নেতা সরকারের প্রতিহিংসায় পড়ে দীর্ঘ কারা নির্যাতন ভোগ করছেন। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (জিসিসি) মেয়র (সাময়িক বরখাস্ত) ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কারাগারে বন্দি অধ্যাপক এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে একটি সাজানো চাঁদাবাজির অভিযোগে জয়দেবপুর থানায় মামলা করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। অধ্যাপক এম এ মান্নানকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন আপিল বিভাগ বহাল রাখার দিনই ২০১৪ সালের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার রাতে এ মামলা করা হয়। এ নিয়ে মেয়র মান্নানের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা হয়েছে। গাজীপুর আদালতের পরিদর্শক মো. রবিউল ইসলাম জানান, টঙ্গীর শিলমুন এলাকার মরহুম বাছির উদ্দিনের ছেলে মো. রমিজ উদ্দিন বৃহস্পতিবার রাতে জয়দেবপুর থানায় চাঁদাবাজি ও মারধরের অভিযোগে মামলাটি করেন। মামলায় অধ্যাপক এম এ মান্নানসহ সাতজনের নামে এবং অজ্ঞাত আরো দু-তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। কারাবন্দি মেয়র মান্নানকে গ্রেফতার দেখাতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। আদালতের বিচারক মো. ইলিয়াস রহমান আসামি অধ্যাপক এম এ মান্নানকে গ্রেফতারের আদেশ দেন। সিটি কর্পোরেশনের ত্রাণ ও দরিদ্র তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের মামলায় ১৯ জুন মেয়র মান্নানকে সব শেষ গ্রেফতার দেখানো হয়। বৃহস্পতিবার এ মামলায় তার জামিন সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেয়া আদেশ আপিল বিভাগ বহাল রাখেন। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা অধ্যাপক এম এ মান্নানকে এবার চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলে তার মুক্তি ফের আটকে গেল। অধ্যাপক এম এ মান্নানের প্রধান আইনজীবী মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, অধ্যাপক এম এ মান্নানকে এ পর্যন্ত ২৮টি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি ২৭ মামলায় জামিন পান। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে জয়দেবপুর থানায় দায়ের করা নাশকতার একটি মামলায় গত বছর ২৩ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভের পর আরো একটি নতুন মামলায় তাকে ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখানো হলো। বর্তমানে অধ্যাপক এম এ মান্নান গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এ রয়েছেন। তিনি বিএনপির সদ্য ঘোষিত জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হয়েছেন। : উচ্চ আদালত থেকে দুটো মামলাতেই জামিন পেয়ে মুক্তি পাচ্ছেন না সিলেটের মেয়র আরিফুল হক। কারাগারেও পৌঁছে গেছে জামিন আদেশ। তবুও মুক্ত হতে পারছেন না। অন্য একটি মামলায় তাকে সুনামগঞ্জের আদালতে হাজির করতে কারাগারের প্রতি আদেশ থাকায় থমকে আছে তার মুক্তি প্রক্রিয়া। গত ২৭ নভেম্বর এ মামলায় আরিফুল হককে সুনামগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে। এ হাজিরার পর নতুন করে যদি কোনো দায় না চাপে তবে আর কোনো বাধা নেই আরিফুল হকের মুক্তিতে। আবার তিনি মুক্তভাবে পথ চলতে পারবেন প্রিয় নগরে এমনটাই প্রত্যাশা তার শুভার্থী-অনুসারীদের। আরিফুল হক চৌধুরীর শুভানুধ্যায়ীদের কারো কারো প্রত্যাশা অবশ্য আরো একটু বেশিই। তারা স্বপ্ন দেখছেন নগর ভবনের শীর্ষ চেয়ারটিতে বসার অধিকারও ফিরে পাবেন আরিফুল হক। তাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামান মনির স্বপদে ফিরে আসার প্রক্রিয়াটি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মনিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে খুলনার মেয়রের দায়িত্ব। আরিফুল হকের মতো তিনিও মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর মেয়র পদ থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দেয়া বহিষ্কারের সে আদেশকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন মনি। তার দায়ের করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বহিষ্কারাদেশ ৬ মাসের জন্য স্থগিত রাখেন। পরে আপিলেও সে সিদ্ধান্ত বহাল থাকায় সরকার মনিরুজ্জামান মনিকে খুলনার মেয়র পদে পুনর্বহাল করে। : আরিফুল হকের বিরুদ্ধে থাকা দুটো মামলার মধ্যে কিবরিয়া হত্যা ঘটনায় দায়ের হওয়া মূল মামলায় গত ৬ সেপ্টেম্বর আরিফুল হক চৌধুরীকে জামিন প্রদান করেন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরে জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ৮ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ সে আবেদন নাকচ করে দেন। অপরদিকে ১৩ নভেম্বর বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আরিফুল হক চৌধুরীকে হত্যা সংশ্লিষ্ট বিস্ফোরক মামলায়ও জামিন দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন পরদিনই খারিজ করে দেন চেম্বার জজ  সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। যে দুটো মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আরিফুল হক কারাগারে বন্দি আছেন, দুটো মামলাতেই উচ্চ আদালতে জামিন পেয়েছেন তিনি। আপিলেও স্থগিত হয়নি সে জামিন। তাই তার কারামুক্তিতে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু তার আগেই কারাগারের প্রতি আদালতের একটি নির্দেশনা আসে। ২০০৪ সালের ২১ জুন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা সদরের জগন্নাথ জিওর মন্দিরের কাছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় আরিফুল হককে হাজির করা হয়। কারণ ঐ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদন আরিফুল হক চৌধুরীকেও ঐ মামলায় আসামি করা হয়। নতুন করে  এ মামলায় আরিফুল হককে সুনামগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের  বৈদ্যেরবাজারে ঈদ-পরবর্তী এক জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলায় মৃত্যু হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার। এ মামলায় সংশোধিত সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরিফুল হক চৌধুরীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয় তিনি তখন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। সেই সংশোধিত সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর মেয়র আরিফুল হকসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের  বৈদ্যেরবাজারে এক জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলায় মৃত্যু হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার। এ মামলায় সংশোধিত সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরিফুল হক চৌধুরী ও জি কে গউছের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। সে মামলাতেই তারা দুজনে কারাগারে আছেন। কারাগারে থাকাবস্থায়ই আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় আরিফুল হক ও জিকে গউছকে যুক্ত করতে আদালতে আবেদন করেন ঐ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হবিগঞ্জ জোনের সহকারী পুলিশ সুপার বসু দত্ত চাকমা। ইতিমধ্যে কিবরিয়া হত্যা সংশ্লিষ্ট দুটো মামলায়ই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন আরিফুল হক। আর জি কে গউছ জামিন পেয়েছেন একটি মামলা থেকে। : রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনকে প্রায় অর্ধলাখ ভোটে পরাজিত করে মেয়র হয়েছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। কিন্তু পুলিশ সদস্য সিদ্ধার্থ সরকার হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। মেয়র হওয়ার পর দুই দফা জেলে যাওয়া ছাড়াও তাকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন। এখন জামিনে মুক্তি পেয়ে প্রকাশ্যে থাকলেও স্বপদে নেই। তার বিরুদ্ধে ৯টি ফৌজদারি মামলার খড়গ ঝুলছে। মেয়র পদ ফিরে পাওয়ার জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতা। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাকে দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ মান্নান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাশিমপুর কারাগারে অন্তরীণ। তার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলার খড়গ ঝুলছে। : শুধু বুলবুল বা মান্নানই নন, বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত স্থানীয় সরকারের অধিকাংশ মেয়র বা চেয়ারম্যানের একই অবস্থা। বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের কেউই ভালো নেই। সিটি মেয়রদের কেউ জেলে, কেউ রয়েছেন পদের টেনশনে। পৌর মেয়রদের কেউ কেউ ফেরারি। জানা যায়, বিগত আড়াই বছরে তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন সিটি মেয়র ছাড়াও ২১ পৌর মেয়র, ৪৪ কাউন্সিলর, ৪৭ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ৫৮ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৮৬ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ৫৪ জন ইউপি সদস্যকে ফৌজদারি মামলায় বহিষ্কার করা হয়েছে। যারা পদে রয়েছেন তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগকে ‘ম্যানেজ’ করেই কোনোমতে টিকে আছেন বলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। আবার অনেকেই রয়েছেন আত্মগোপনে। : এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের যেভাবে বরখাস্ত করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রে কাম্য নয়। এতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। যাদের বরখাস্ত করা হয়েছে, তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক মামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতির অভিযোগে মামলা নেই বললেই চলে। আবার এখন একটি অলিখিত বিধি চালু হয়েছে, যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিও সেই সরকারের হতে হবে। এ মানসিকতা পরিহার করতে হবে। স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন), স্থানীয় সরকার (পৌরসভা), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) ও স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যে কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (আদালত কর্তৃক চার্জশিট গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পরপর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে।

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট