১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২৫, ২০২১
আজ ২৫ মার্চ। জাতীয় গণহত্যা দিবস। পূর্ব পাকিস্তানকে দমনের অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের আজকের এই রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের হঠকারী সামরিক শাসকশ্রেণী ইতিহাসের এক জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছিল। অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত ঠাণ্ডা মাথায় পরিচালিত ২৫ মার্চ রাতের নির্বিচার গণহত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অমোচনীয় দগদগে ক্ষতচিহ্ন।
ইতিহাসে ২৫ মার্চ ‘কালরাত’ হিসেবে পরিচিত। এ হিসেবেই এত দিন দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। তবে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে প্রস্তাব পাস হয়।
আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ পরিহার করে ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তান শাসকশ্রেণী অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ঘুমন্ত অসহায় মানুষের ওপর। চাপিয়ে দেয় অন্যায় যুদ্ধ। অনিবার্য করে তোলে বহু ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র স্বপ্নের পাকিস্তানের ভাঙন। শুরু হয় এ অঞ্চলের বঞ্চিত মানুষের আলাদা করে বাঁচার রক্তক্ষয়ী লড়াই; যার ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নানা নিপীড়নের শিকার হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর হাতে, যা ছিল এ অঞ্চলের মানুষের কল্পনার বাইরে। কিন্তু তা-ই সত্যে পরিণত হলো। ঔপনিবেশিক-বর্ণবাদী শোষণ আর বৈষম্য থেকে বাঁচার জন্য মুসলমানরা আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান চেয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পরপরই বঞ্চনার নতুন অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে লাগল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। পাকিস্তান বিষয়ে মোহভঙ্গ হতে শুরু হলো এ অঞ্চলের মানুষের। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে বারবার রাজপথে নামতে বাধ্য করা হয়।
এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি শাসকশ্রেণীর অবহেলা ও উদাসীনতার জবাব দেয়া হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু শাসকশ্রেণী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নিজেদের হাতেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ফলে আবার রাজপথে নামতে বাধ্য হয় মানুষ। পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য দাবি আদায় এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের দাবিতে আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন ১৫ মার্চ আলোচনার জন্য ঢাকা আসেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৬ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তার সাথে পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ জেনারেল ও পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা আসেন আলোচনায় যোগ দিতে। মূলত আলোচনার নামে এটি ছিল একটি প্রতারণা ও সময়ক্ষেপণ মাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান নেতৃবৃন্দ প্রতিদিন সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে গোপনে অস্ত্র এবং সৈন্য জমা করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে। ২৪ মার্চ উচ্চপদস্থ জেনারেলরা ঢাকা ত্যাগ করেন আন্দোলন দমনে গণহত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে। ঢাকায় রয়ে যান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ২৫ মার্চও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার প্রহসনের আলোচনার তারিখ ধার্য করা ছিল।
২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন ইয়াহিয়া খান। রাত ১১টায় তিনি করাচি পৌঁছার খবর ঢাকায় পাঠানোর পরপরই শুরু হয় গণহত্যার অভিযান। রাজপথে নেমে আসে ট্যাঙ্ক ও সশস্ত্র সৈন্য। পূর্ব পাকিস্তানের সব ক্যান্টনমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশী সব অফিসারকে হত্যা ও সাধারণ সৈন্যদের নিরস্ত্র করা ছিল এ অভিযানের লক্ষ্য। এ ছাড়া আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে হত্যাসহ আন্দোলনের সব ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়ার টার্গেট করে তারা। সে লক্ষ্যে প্রথমে তারা হামলা চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর সদর দফতরে। ২৫ মার্চের কালরাতের এ গণহত্যার অভিযান ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচিত।
তবে সব জায়গায়ই পাকিস্তানিরা প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশী সৈনিক, পুলিশ, ইপিআর সদস্যদের। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও ইপিআর অপারেশনে অনেক বাংলাদেশী পুলিশ ও জওয়ান নিহত হয়। ঢাকা ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের সংখ্যাধিক্য থাকায় এখানে বাংলাদেশীদের অধিক পরিমাণে হত্যার সুযোগ পায় তারা। হত্যাকাণ্ড চালানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা ও ছাত্রাবাসগুলোয়। ধ্বংসলীলা চালানো হয় গভর্নর হাউজ, প্রেসিডেন্ট হাউজ, মিরপুর, শাঁখারীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায়। বিভিন্ন স্থানে করা হয় অগ্নিসংযোগ। অসহায় নারী-পুরুষ ও শিশুদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে রাতের আকাশ।
ঢাকার বাইরে অন্যান্য ক্যান্টনমেন্ট যথা চট্টগ্রাম, যশোর, রংপুর ও জয়দেবপুরে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলাদেশী সৈনিক ও জওয়ানরা। চট্টগ্রামে রাত ১১টায় মেজর জিয়াউর রহমানকে যখন বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল (হত্যার জন্য) তখন তিনি পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কৌশলে নিজেকে রক্ষা করেন এবং পরে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের অনেককে বন্দী করেন। একইভাবে জয়দেবপুরে মেজর শফিউল্লাহ ও মেজর মইনুল হোসেন, কুমিল্লায় মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিল, রংপুরে ক্যাপ্টেন আশরাফ ও আনোয়ারের নেতৃত্বে এবং যশোর ক্যান্টনমেন্টে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। চট্টগ্রামে প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহত বাংলাদেশী সেনাদের কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা।
২৫ মার্চ রাতে শুরু হয়ে ২৬ মার্চ বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে এ গণহত্যা ও নিধনযজ্ঞ। এ হত্যা অভিযানে কত মানুষ নিহত হয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। শুধু রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সেই সাত শতাধিক পুলিশ সদস্য নিহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন অধ্যাপককে হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চ ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ফুটে ওঠে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাতের বর্বরতার নৃশংস আর হৃদয়বিদারক চিত্র। পিচঢালা রাজপথে এখানে-সেখানে পড়ে থাকে রক্তাক্ত লাশ আর লাশ। ফুটপাথে, বস্তি এলাকায়, রেল ও বাসস্টেশন, রিকশা ও ভ্যানের ওপর ঘুমন্ত অসহায় ভাসমান কোনো মানুষই রেহাই পায়নি পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর নির্মম বর্বরতা থেকে।
২৫ মার্চ অভিযান পরিচালনার সাথে সাথে রাত ১২টার অল্প কিছুক্ষণ পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় শেরেবাংলা নগর সদর দফতরে।
বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নামতে বাধ্য হলেও শেষ পর্যন্ত তারা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু অস্ত্রের বলে বলীয়ান পশ্চিম পাকিস্তানের হঠকারী সামরিক শাসকগোষ্ঠীর মাথায় কোনো শুভ চিন্তা তখন কাজ করেনি। তাদের শঠতায় অনিবার্য হয়ে ওঠে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথ। ২৫ মার্চের কালরাতের পরই নির্ধারিত হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলা।
EDITOR & PUBLISHER :
DR. ARIF AHMED MOMTAZ RIFA
MOBILE : 01715110022
PHONE : 0821 716229
Office : Central Market (1st floor),
Bandar Bazar (Court Point),
Sylhet – 3100, Bangladesh.
E-mail : sylhetsangbad24@gmail.com
Hello : 01710-809595
Design and developed by M-W-D