যেভাবে ইসলামের পথে চার ল্যাটিন নারী

প্রকাশিত: ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০১৬

ওয়াশিংটন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ইসলাম ধর্মকে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল একটি ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন মুসলমান বাস করছে। একটি মুসলিম সংগঠনের তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে প্রায় ২,০০,০০০ ল্যাটিন মুসলমান রয়েছে এবং এ সংখ্যা কেবল বৃদ্ধিই পাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিশ্বাসের মতো ল্যাটিন জনসংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে ল্যাটিনরা মোটামুটিভাবে দেশটির জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ হবে।

ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন আইবেরিয়ান উপদ্বীপে (বর্তমানে স্পেন এবং পর্তুগাল)  ইসলামের আগমন ঘটে ৭১১ বছর আগে। ওই সময় উত্তর পশ্চিম আফ্রিকার অন্তর্গত মরক্কোর অধিবাসীরা এ অঞ্চল জয় করেন এবং প্রায় ৮০০ বছর ধরে সেখানে শাসন করেন। এই সময়ে সেখানে ইসলামী প্রভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এ সময়েই বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা, জটিল স্থাপত্য রীতি গড়ে ওঠে।

অনেকের মতে, তাদের শাসন ব্যবস্থা মুসলমান, ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সহনশীলতাও সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

যুক্তরাষ্টের লং বিচ ইসলামিক সেন্টারে চার ল্যাটিন নারী তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার গল্প শোনানোর পাশাপাশি এই ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং তাদের ল্যাটিন এবং ইসলামী সংস্কৃতির মূল্যবোধ সম্পর্কেও কথা বলেন।

মাইরি (২৫)

মাইরি তার ইসলাম গ্রহণের প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময় নেন। কারণ তিনি যে ল্যাটিন পরিবারে জন্ম নেন যেটি তীব্রভাবে ক্যাথলিক অনুগত ছিল। ২০ বছর বয়সে তার ইসলামের যাত্রা শুরু হয়; ওই সময় একজন মুসলিম তরুণের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের তিন মাস পরে তিনি কালেমা শাহাদাত পড়ে মুসলিম হন।

ল্যাটিন কমিউনিটিতে মুসলমান হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেন যে, ইসলামি আক্বীদা সম্পর্কে তার পরিবার এবং বন্ধুদের প্রতিনিয়ত বুঝাতে হবে এবং হয়রত মুহাম্মদ (সা.) এর শিক্ষা তাকে এ বিষয়ে প্রেরণা যুগায়।

তিনি বলেন, ‘আমি মেক্সিকোর একটি  ল্যাটিন পরিবারে প্রতিপালিত হই। যেটি পুয়ের্তো রিকান এবং ক্যাথলিক অনুগত। এরকম একটি পরিবারে জন্ম নিয়ে তাদের আদর্শের বাইরে গিয়ে মুসলিম হওয়াটা আমার জন্য খুব একটা সহজ ছিল না।’

মাইরির ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত কেবল একজন ছাড়া তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য কর্তৃক ঘৃণিত হয়। তার চাচা তার এ সিদ্ধান্তে অত্যন্ত খুশি হন।

তার চাচা ১৯৭০ সালে কারাবন্দী হওয়ার আগে পর্যন্ত ক্যাথলিক ধর্ম চর্চা করেন। ওই সময়ে তিনি ম্যালকম এক্স এর আত্মজীবনী পড়ে তার প্রতি অনুগত হন। নাগরিক অধিকার নিয়ে লড়াইকারী নেতা ম্যালকম এক্স ১৯৬৪ সালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মাইরি ইসলাম গ্রহণ করেছেন- এটি জানার পর তার চাচা জেলে বসে ইসলামের সৌন্দর্য বর্ণনা করে তাকে একটি চিঠি লিখেন এবং ব্যাখ্যা করেন তাকে নিয়ে তিনি কতটা গর্বিত। মাইরি যখনই কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতো তখনই তিনি তার চাচার চিঠি পড়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিত।

কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তিনি মাইরির আত্মবিশ্বাসী যে, ল্যাটিন সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি দেখেছি হিস্পানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলাম ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তাদের জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা তাদের জন্য ইসলামের প্রবেশ পথ হিসেবে কাজ করব। আমরা উভয় ভাষায় কথা বলি এবং এটি তাদের ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সহায়তা করবে। মুসলমান ও ল্যাটিনদের একই অন্তঃস্থল এবং কিছু বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে জয় করতে সক্ষম হয়েছি।’

লিনা (২৯)

লিনার ইসলামের যাত্রা অন্যদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন উপায়ে হয়েছে। লিনার বাবা-মা তার জন্মের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং তারা তাদের ল্যাটিন পটভূমিতেই সংযুক্ত ছিলেন। এটি তার বাবা-মায়ের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ ছিল তেমনি তার জন্যও।

তিনি বলেন, ‘আমার মা ছিলেন পেরুর নাগরিক এবং সেখানে আমাদের প্রায় যেতে হতো। আমার আত্মীয়রা পার্টিতে, সমুদ্র সৈকতে যেত। সেখানে আমাকে সংস্কৃতি যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হতো কিন্তু তারা সবাই জানত যে, আমি মদ্য পান করি না। তাই আমি কোনো চাপ অনুভব করতাম না। কিন্তু এটা আমার জন্য খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল যেখানে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে আমার ধর্ম এবং বিশ্বাস হারানো ছাড়াই খাপ খাইয়ে নিতে পারি।

লিনা যখন তার পরিবারের সঙ্গে পেরু ভ্রমণে যেত তখন ল্যাটিন সাংস্কৃতি এবং তার ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে ভারসাম্য খোঁজে পাওয়া তার জন্য একটি সংগ্রাম ছিল। কিন্তু এই মানসিক চাপ যুক্তরাষ্টের লস অ্যাঞ্জেলসেও অব্যাহত থাকে। যেখানে অন্য মুসলমানরা তার ইসলামের ‘প্রতিশ্রুতি’ নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন তুলতেন।

তিনি বলেন, ‘তারা সবসময় আমার ইসলামের মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলত এবং আমি সত্যিই মুসলিম কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করত এবং এটা সত্যিই অন্যায়। আমরা যখন মিসরীয় মসজিদে যাই তখন তারা ভাবত আমরা মিশরীয় এবং মানুষ আমাদের সঙ্গে আরবি ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। তারপর তারা আমাদের জিজ্ঞাসা করত কিভাবে আমরা মিশরীয়, তাহলে আমরা আরবিতে কথা বলতে পারি না কেন? ঠিক আছে, আমি মিশরীয় নই এবং তারা আপনাকে এই সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে। এটা অনেকটা দ্বৈত জীবনে বাস করার মতো।’

যাইহোক তার মতে, কোনো জাতিগত বা বর্ণবাদী পরিচয়ের চেয়ে ইসলামের পরিচয় অনেক বড়।

তিনি বলেন, ‘ইসলাম এমন একটি ধর্ম এবং বিশ্বাস যা আপনার ত্বকের রং এর উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়নি। এটা একটা বিশ্বাস এবং এটি একটি জীবনধারা। এটা ল্যাটিন কিংবা এশিয়ান কিংবা কালো বর্ণের চেয়ে অনেক বড়। ইসলাম এমন কিছু যা বিশেষ কিছুর চেয়েও অনেক বেশি।’

নোয়েলিয়া (৩৫)

একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নোয়েলিয়ার ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। তার প্রেমিককে বিয়ে করার আগে নোয়েলিয়া প্রায়শই লস এঞ্জেলেসের একটি মসজিদে যেতেন।

তিনি জানান, মসজিদটিতে তিনিই ছিলেন একমাত্র লাতিনা যেখানে তাকে সব ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো। তিনি তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় মুগ্ধ ছিল। তার বোন জামাই তাকে ইসলাম সম্পর্কিত একটি বই প্রদান করেন যা তাদের সঙ্গে আলোচনায় তাকে সহায়তা করে। তিনি গর্ভবতী হলে কালেমা শাহাদাত পড়ে তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন একটি ভাল ভিত্তির ওপর তার সংসার জীবন শুরু করতে।

তাকে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে যেটি ল্যাটিন আমেরিকায় ও যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদেরকে সহ্য করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আমেরিকান সমাজে মুসলিম পরিচয় বহন করা এক ধরনের বিশাল ভার বহনের মতো। এখানে আমরা এখনো সংখ্যালঘু এবং হিজাব পড়ে বাইরে বের হলে আমাকে আরো বেশি সংখ্যালঘু মনে হয় এবং আমেরিকানদের একঘেয়েমির কারণে আমাকে এই বিশাল ভার বহন করতে হবে।’

একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে ওঠার পর ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ায় তাকে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শহরটি ছোট হওয়ায় অনেকেই আমাকে চিনত। একারণে আমাকে তাদের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।

কিন্তু আমি শিখেছি, বাইবেল ও কুরআনের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। প্রথমটি মূসা নবীর ওপর এবং অন্যটি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাজিল হয়েছে। এছাড়াও তাদের মধ্যে অন্যান্য আরো অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে।’

উভয় ধর্মীয় গ্রন্থে মিল খুঁজে পেলেও নোয়েলিয়া সাংস্কৃতিকভাবে ব্যাপক অমিল দেখতে পান। জর্ডানে তার স্বামীর পরিবার দেখার জন্য ভ্রমণে তিনি সবচেয়ে জ্ঞানগর্ভ অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং ল্যাটিন ও আরব সমাজের সাংস্কৃতিকগত যে পার্থক্য তা ভালবাবেই বুঝতে পারেন।

নোয়েলিয়া বলেন, ‘এটা ছিল আমার প্রথম জর্ডান ভ্রমণ। সেখানে আমি প্রথমবারের মতো একটি বড় পরিবারে বসবাসের অভিজ্ঞতা লাভ করি। সেখানে সবাই আমাকে হাসি মুখে বরণ করে নেয় এবং আশেপাশের অনেক প্রতিবেশি কেবল আমাকে দেখার উদ্দেশ্যে শ্বশুর বাড়িতে ভিড় করেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা যেটা তা হলো, আমার স্বামীর ছোট্ট ভাগ্নী আমার কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি নামাজ পড়ি কিনা। সত্যিই এটা ছিল একটি শক্তিশালী মুহূর্ত এবং এটা আমাকে আরবি শিখতে এবং কুরআন জানতে সহায়তা করেছে।’

ওই মুহূর্তটি নোয়েলার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তার নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে স্বামীর সংস্কৃতির পার্থক্যের বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।

তিনি বলেন, ‘ইসলাম এবং হিস্পানিকদের কথা ভাবতে গিয়ে আমি কেবল ভালবাসা এবং পরিবারের কথাই ভাবতে থাকি। ল্যাটিন সমাজ আমাদের পরিবার নিয়ে গর্বিত। পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি আমরা যে সম্মান দেখাই যেটি ল্যাটিন সমাজে খুব একটা দেখা যায় না। এছাড়াও আপনি এটি ইসলামের আদর্শেও দেখতে পাবেন। আমি এই ধরনের ভালবাসা আমি আগে কখনো দেখিনি। এটা একটা ভাল সমন্বয়।’

মরিয়ম (২২)

মরিয়ম তার মেক্সিক্যান মায়ের কাছে বেড়ে ওঠেন এবং ২০ বছর বয়স পর্যন্ত ক্যাথলিক ধর্ম চর্চা করতেন। কিন্তু ক্যাথলিক ধর্ম চর্চা করতে গিয়ে তিনি চাপ বোধ করতে থাকেন। কেননা তাকে তার ধর্ম নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন করার অনুমতি দেয়া হয়নি।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘যখন আমি ক্যাথলিক ধর্ম চর্চা করি, তখন এ নিয়ে আমার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হলেও কোনো জবাব পেতাম না। সবসময় এর উত্তর ছিল: কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে না। অন্যদিকে, ইসলামে আমি যেটি শিখেছি তাহলো এতে ধর্ম সম্পর্কে জানতে ও জ্ঞান অর্জনের জন্য আপনাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কোনো বিষয়ে জানা এবং গবেষণা ও সঠিক তথ্য বের করে আনার অধিকার আপনার রয়েছে যেটি ইসলাম আপনাকে দিয়েছে।’

মরিয়মের একজন জর্ডানিয়ান বন্ধুর মাধ্যমে তার ইসলামের সূচনা হয়। ওই বন্ধু তাকে হিজাব পরা থেকে শুরু করে ইসলামের অনেক বিষয়ে শিক্ষা দেন। তিনি কুরআন সম্পর্কেও তাকে অনেক কিছু শেখান।

মরিয়ম ২০১৫ সালে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন এবং এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় তিনি কখনো একাকীত্ব বোধ করেননি।

তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৫ সালের এপ্রিলে ধর্মান্তরিত হই। আমি এটি আরো কয়েক বছর আগেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছু কারণে এটি সম্ভব হয়নি। যাইহোক, আমি ইসলাম গ্রহণ করতে পেরেছি এবং আমি এজন্য মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি কখনো আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করতে পারব না।’

গ্রপের অন্য নারীদের মত মরিয়মের বিশ্বাস যে, ভবিষ্যতে ল্যাটিন সমাজে আরো বেশি করে ইসলামের প্রসার ঘটবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক বছর ধরে আমাদের জাতিকে নির্মাণ করছি। আমরা এখানে ইসলামেরও প্রসার ঘটাতে পারি এবং ইতোমধ্যে এটি শুরু হয়ে গেছে। আমরা হিস্পানিক সম্প্রদায়কে ইসলামের পথে আনার চেষ্টা করছি। আমরা তাদের জন্য একটি মাধ্যম হিসেবে আছি। যদিও বর্তমানে এটা অনেকটা কঠিন কাজ।’

ফ্যাশন ডটনেট অবলম্বনে মো. রাহুল আমীন