শিশু নির্যাতন বাড়ছেই

প্রকাশিত: ১:৫৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৭, ২০১৬

মাসুদুর রহমান : দেশে শিশু ধর্ষণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাদের জীবনে নেমে আসছে ভয়াবহ অন্ধকার। যেন ফুল ফোটার আগেই কলি ঝরে যাওয়ার মতো। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে সেইসব অপরাধীরা। বিচারহীনতায় ক্রমাগত এসব অপরাধের ফলে শুধু ধর্ষিত শিশুটিই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পারিবার ও সামাজ ব্যবস্থা। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার তথ্য মতে, গত সেপ্টেম্বরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১ জন নারী-শিশু। এরমধ্যে শিশু ১০ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং শিশু অধিকার ফোরামের মতে, গত ছয় মাসে দুই শতাধিক শিশু ধর্ষণের ও ২৩ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির ধারণা, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে ২৯১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যাদের ৩৯ জনই গণধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে ২৮ জন ছিল প্রতিবন্ধী। ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। এই সময়ে ১৮ শিশুর ধর্ষণের মামলার রায় হয়েছে। তবে রায় হওয়া মামলাগুলো ছিল ২০১০ সাল থেকে গত বছর বা তারও আগের সময়ের। খাগড়াছড়িতে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে কোলে তুলে নিয়ে হোটেলে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে বখাটেরা। গত ১ অক্টোবর সকালে নানির বাড়ি যাওয়ার পথে গঞ্জপাড়া সেতু এলাকা থেকে মেয়েটিকে মোটরসাইকেলে করে তুলে এনে জেলার কুমিল্লাটিলা এলাকার হোটেল ইকোছড়ি ও শাপলা চত্বর এলাকার হোটেল ফোরস্টারে তিনদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে মাহমুদুলও তার বন্ধুরা। : গত ২ অক্টোবর রবিবার ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট উপজেলার ৮ নং নড়াইল ইউনিয়নের এক গ্রামে ৪ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিকালে বাড়ির পাশে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলার সময় প্রতিবেশী জহুরুল (২৩) টাকা দেয়ার লোভ দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে একটি গর্তের মধ্যে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে বলে জানায় শিশুটির মা। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার পল্লীতে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে শিক্ষকের কাছে ধর্ষণ শিকার হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়–য়া দুই শিশু। গত কয়েকদিন ধরে তারা পড়তে যেতে চাইছিল না। সোমবার শিশু দুটি তাদের মাকে ধর্ষণের ঘটনা জানায়। পরের দিন তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০ সেপ্টেম্ব^র টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে গণধর্ষণের শিকার হয় তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী। এ নিয়ে মামলা হলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে অপরাধীরা। ক্রমাগত হুমকির ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় পুলিশি পাহারায় হাসপতালে চিকিৎসা চলে শিশুটির। অভাবের সংসারে বাবা-মা কাজে যাওয়ার পর বাড়িতে একা পেয়ে ওই শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে খোকন ও তার বন্ধুরা। খোকন বহুরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও মির্জাপুর উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা। গত আগস্ট মাসে গাজীপুরের বাংলাবাজার এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় মাত্র আট মাসের এক শিশু। শিশুর বাবা স্থানীয় বাংলাবাজার এলাকার একটি ফেব্রিক্স কারখানায় চাকরি করেন। তিনি স্ত্রী, একমাত্র সন্তান এবং পরিবার পরিজন নিয়ে বাংলাবাজার গজারিয়াচালা এলাকায় মিজানের বাড়ি ভাড়া থাকেন। ঘটনার দিন সকালে শিশুকে তার ফুপুর কাছে রেখে রান্না করতে যান তার মা। ফুপু আবার পাশের বাড়ির সেলিম মিয়ার (৪০) স্ত্রীর কাছে শিশুটি রেখে তার ঘরের ফ্যান বন্ধ করতে যান। সেলিমের স্ত্রী শিশুটিকে তার ঘরে রেখে বাইরে কাজে যান। এ সুযোগে সেলিম ওই শিশুটিকে ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণ করে। এ সময় শিশুর চিৎকারে তার মা ও আশপাশের লোকজন আসলে সেলিম পালিয়ে যায়। এভাবে ঘটনার পর ঘটনা চলছেই।  যারা শিশুদের ধর্ষণ করছেন, তাদের বড় অংশ শিশুদের পরিচিত, স্বজন। তাদের কেউ কেউ প্রৌঢ়, কেউবা কিশোর ও যুবক। চকলেট-বিস্কুট কিংবা খেলনার প্রলোভন দেখিয়ে তারা কোমলমতি শিশুদের নির্জনে  ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের শিকার প্রতিটি শিশুই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। অবুঝ এইসব শিশুরা পরিষ্কারভাবে আঘাতের কথা বলতে না পারায় অনেক সময় তাদের হাসপাতালে নিতেও দেরি হয়। যার কারণে পরবর্তীতে মা হওয়ার ক্ষমতা হরিয়ে ফেলেন এবং অনেকের মৃত্যুও হয়ে থাকে। : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার শিশু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও সংক্রমণের কারণে মারা যেতে পারে। অনেকে আর মা হতে পারে না।’ চিকিৎসকেরা শিশুর শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক ক্ষতির কথাও বলেন। এমনকি নিজের পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরও তারা শত্রু মনে করে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ চিকিৎসক তাজুল ইসলাম বলেন, শৈশবে ধর্ষণের শিকার শিশুরা পৃথিবীকে বৈরী মনে করে। অনেকে আঘাত সহ্য করতে না পেরে বোবা হয়ে যেতে পারে, অনেকের খিঁচুনি হয়, কেউ কেউ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। : নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ১ হাজার ১৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে সেবা নেয়। তাদের ৭২৫ জনই শিশু। একমাত্র বিচার নিশ্চিত করা গেলেই এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন এই কর্মসূচির কর্মকর্তারা। এখন পর্যন্ত ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের বিচারের যে চিত্র, তা খুব করুণ। এ প্রোগ্রামের আওতায় দেশের ১০টি সরকারি হাসপাতালে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার ৩৮৬ জন ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫ হাজার ৩টি। রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টির, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ। : নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, ‘শিশুদের বিষয়টা যারা দেখছেন, তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার। আইনজীবীদের জেরায় অনেক সময়ই শিশুরা ভয় পেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ওপর বেশি জোর দেয়া যেতে পারে। বিচারক ক্যামেরা ট্রায়ালের উদ্যোগ নিতে পারেন। আলাদাভাবে শিশুর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন, অজ্ঞতার কারণে আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের দোড়গোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। ফলে এসব অপরাধ ঘটছেই। : বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের ১শ অপরাধে গড়ে ২টার বেশির শাস্তি হয় না। আমার জানা মতে, গত ৫ বছরে গণধর্ষণের ৯৮ শতাংশ অপরাধে কারও শাস্তি হয়নি। যে অপরাধে শাস্তি হয় না, সেই অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক।