বাংলাদেশে নুতনদের জন্য ক্লাব ফুটবলের সম্ভাবনা কতটা আছে?

প্রকাশিত: ১০:৪৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ৬, ২০১৮

বাংলাদেশে নুতনদের জন্য ক্লাব ফুটবলের সম্ভাবনা কতটা আছে?

বাংলাদেশে এই মূহুর্তে দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ১৭ শতকের শেষের দিকে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ফুটবল খেলা চালু হয় এ অঞ্চলে।

ক্রমে সেটি হয়ে উঠেছিল উপ মহাদেশের প্রধান খেলা। স্থানীয় ক্লাবের জনপ্রিয়তাও ছিল তুমুল, ফুটবল নিয়ে গান, কবিতা, গল্প-উপন্যাস, সিনেমা আর রম্য রচনাও রচিত হয়েছে বহু।

এখনো প্রতি চার বছর অন্তর যখন বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হয়, সারা পৃথিবীর মত বাংলাদেশেও দেশ জুড়ে দেখা যায় তুমুল উন্মাদনা।

এর মধ্যে বিভিন্ন দলের সমর্থকদের মিছিল, নামী খেলোয়াড়দের নামাঙ্কিত জার্সি পরা, পতাকা টাঙানোর ধুম, আর একসাথে দল বেঁধে খেলা দেখা—সবকিছুতেই চলে আসে উৎসবের আমেজ।

কিন্তু ফুটবল নিয়ে যে বাংলাদেশীদের এত আবেগ, নিজেদের ছেলেমেয়েদের তারা কতটা ফুটবল খেলতে দেন?

ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মনন মোর্শেদ। ছাত্রজীবনে নিজে খেলাধুলা করেছেন, কিন্তু এখন তার দুই ছেলের কেউই সে অর্থে খেলাধুলা করেনা। আর ছেলেরা ফুটবলকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে, এমনটাও তিনি ভাবেননা

‘ছেলেদের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়নি, আমি বা তারা কারোই জানার সুযোগ হয়নি তারা ফুটবল পছন্দ করে কিনা। আর তারা পেশা হিসেবে ফুটবলকে পেশা হিসেবে নেবে এটা আমি ভাবি না। তার কারণ, এখন খেলার সুযোগই তেমন নাই। আর ফুটবল খেলে জীবনধারণ করা যাবে সে নিশ্চয়তাও নাই।’

কিন্তু এখনকার অভিভাবকেরা কেন ভাবতে পারেন না, তার সন্তান ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে মেসি, রোনাল্ডো কিংবা নেইমারের মত নামী ফুটবলার হয়ে উঠবে?

সেই বিশ্লেষণে যাব, কিন্তু তার আগে এখন যারা ফুটবল খেলছে, তাদের গল্প শুনে আসি।

ঢাকার মতিঝিলে আরামবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের মাঠে জনা বিশেক কিশোর তরুণ অনুশীলন করছিলেন এখানে। এদের বয়স ১১ বছর থেকে ২১ বছরের মধ্যে। এদের সবার লক্ষ্য ভালো ফুটবলার হয়ে ওঠা। পেশা হিসেবে প্রায় সব কজন ফুটবলকে বেছে নিতে চান।

এদের মধ্যে ছিলেন রায়হান ইসলাম আর সাগর হোসেন

‘আমি ছোটবেলা থেকে এই ক্লাবের আশেপাশে প্রাকটিস করি কিন্তু বুট পায়ে খেলি নাই কখনো। একদিন এক বড় ভাই যিনি এখানে খেলতেন, উনি খেলা দেখে সাহস দিলেন, আসতে বললেন। তারপর থেকে খেলতেছি।’

‘আমি নিজেকে ঠিকমত গড়ে তুলতে পারলে আমি ক্লাবে ভালো খেলব, আমার সম্ভাবনা থাকবে একে পেশা হিসেবে নেবার। এখন আমরা আবাহনী, মোহামেডান এর জুনিয়র দলগুলোর সাথে সপ্তাহে চারদিন প্রাকটিস করি।’

ফুটবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে থাকেন, বাংলাদেশে ফুটবলের সেই সুদিন এখন আর নেই।

ব্বই দশকের পর থেকেই এখানে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল ক্লাবগুলো কতটা আকর্ষণ করতে পারছে নতুন তরুণ কিশোরদের? ফি বছর ক্লাবগুলোতে কি পরিমাণ ছেলেমেয়ে খেলতে আসে বা খেলা শিখতে আসে?

আরামবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ ইব্রাহিম খলিলু্ল্লাহ বলছেন, প্রতিবছর ২০-২৫জন নতুন ছেলে খেলতে আসে

‘বছরে ২০-২৫জন নতুন ছেলে খেলতে আসে। আর দেখা যায় গড়ে ৪০-৪৫জন নিয়মিত অনুশীলন করে। আমাদের নিজেদের ক্লাবের জন্য তাদের তৈরি করি, আবার অন্য ক্লাবেও পাঠাই ছেলেদের মানে এখানে গড়েপিঠে দিলাম, তারপর অন্য ক্লাব নিলো তাদের।’

বাংলাদেশে ছোট বড় মিলে ২৬টি ফুটবল ক্লাব আছে, এর মধ্যে ঢাকা এবং এর আশেপাশের জেলাগুলোতে মোট ১৪টি ক্লাব সক্রিয় আছে। ক্লাব পর্যায়ে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্ট হয় বাংলাদেশে। সেগুলো সবই ছেলেদের জন্য।

বাংলাদেশের কোন ক্লাবেরই মেয়েদের নিয়মিত কোন দল নেই। মেয়েদের জন্য ক্লাব পর্যায়ে ফুটবল খেলার তেমন কোন সুযোগ নেই, নেই ধারাবাহিক কোন টুর্নামেন্টও।

সর্বশেষ ক্লাব টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের মেয়েরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। এ অবস্থায় অভিভাবকেরা কি নিজেদের কন্যা-সন্তানটিকে পেশা হিসেবে ফুটবলকে বেছে নিতে দেবেন?

জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক এবং বর্তমান কোচ ডালিয়া আক্তারের কাছে

‘তেমন অবস্থা এখনো আসেনি। একটা মেয়ের অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত কিংবা ভবিষ্যতের কোন ধরণের নিশ্চয়তা নেই। খেলতে গিয়ে একটা অ্যাকসিডেন্ট করলে তার ইনসুরেন্স নাই, চিকিৎসাও করাবে না ফেডারেশন বা ক্লাব। কোন বাবা-মা কেন দেবে তার মেয়েকে এখানে আসতে?’

বাংলাদেশে এক সময় ক্লাব ফুটবলের বেশ রমরমা অবস্থা ছিল। আবাহনী, মোহামেডানের মত জনপ্রিয় দলগুলোর খেলা দেখার জন্য মাঠে আসতেন হাজারো দর্শক।

এমনকি চলচ্চিত্রে ক্লাবগুলো নিয়ে গাওয়া গান হয়েছে দর্শকপ্রিয়। কিন্তু সেই ক্লাবগুলোই এখন আর কেন দর্শক টানতে পারছে না মাঠে?

এক সময়ের জনপ্রিয় খেলোয়াড়, এখন আবাহনী লিমিটেডের ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রুপু বলছেন, এজন্য কোন একটি কারণ দায়ী নয়

‘এক সময় বিনোদনের মাধ্যম কম ছিল, লোকে তখন অনেক দেখেছে। কিন্তু এখন ইউটিউবেও খেলা দেখা যায়। তাছাড়া ট্রাফিক জ্যাম আছে, স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে হলে কাউকে অন্তত ছয়ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হবে। তাছাড়া প্লেয়ারদের পারফর্ম্যান্সও এখানে একটা বিষয়।’

এ মূহুর্তে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে বিনিয়োগের অভাবকে চিহ্নিত করছেন খেলোয়াড়, কোচ আর ক্লাব কর্মকর্তা সকলেই। এ ক্লাবগুলোর কোন ব্যবসায়িক মডেলও নাই।

এমনকি ক্লাবের বিভিন্ন আয়ের উৎস হতে পারে যেসব উপায় তাও নেই। ইউরোপের ক্লাবগুলোর একটি বড় আয়ের উৎস মার্চেন্ডাইজ বা লোগো সম্বলিত বিভিন্ন পণ্য বিক্রি, বাংলাদেশে তাও অনুপস্থিত।

ঢাকার একজন জার্সি বিক্রেতা বলছেন, ঢাকাই ক্লাবের জার্সির কোন ধরণের চাহিদা নেই ক্রেতাদের মধ্যে

‘কাস্টোমাররা ইউরোপীয় ক্লাবের জার্সি চায়, ওদের প্রচার আছে, তাই চাহিদা। আমাদের লোকাল ক্লাবের প্রচার থাকলে হয়ত এইসব ক্লাবের জার্সিরও চাহিদা থাকবে।’

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, যেটি ১৯৭৪ সালেই পেয়েছিল ফিফার সদস্যপদ।

কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে ও পেশা হিসেবে ফুটবলকে বেছে নেবার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার কথা বলা হয়, অর্থাৎ অর্থায়ন বা বিনিয়োগের ঘাটতি তা দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাফুফে কি করছে?

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন বলছেন, ‘ক্লাবগুলোর সাথে আমার কথা হয়, নিয়মিত ইন্সট্রাকশন দেই, কিন্তু আমি তো তাদের ফোর্স করতে পারবো না। সমস্যা হলো তারা এখনো ৫০/৬০ বছরের পুরনো প্রাকটিসে চলছে, এখনো ঠিকমত কোন স্ট্রাকচার নাই তাদের।’

‘আর তাদের যদি ফেডারেশন টাকাপয়সা দিতে না পারে তাহলে তারা আমার কথা শুনবে কেন? কিন্তু তাদের সমস্যা হলো তারা সেরকম লাভজনকও নয়।’

এদিকে, বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত ফুটবল শেখার কোন অ্যাকাডেমি নাই।

এর মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা বিকেএসপির একটি অংশ ফুটবল, তাদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এর বাইরে সরকারের বা বেসরকারি খাতে কোন প্রতিষ্ঠান নেই। বাফুফের সালাউদ্দিন বলছেন, সেটিও অর্থ সংকটে আটকে আছে

‘এই মূহুর্তে আমি অ্যাকাডেমী করে দিতে পারবো, কিন্তু সেটা নিয়মিত চালাতে যে টাকাপয়সা লাগবে সেটা কোথা থেকে আসবে? সে বরাদ্দ তো নাই।’

সালাউদ্দিন আরো বলছেন ক্লাবগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিতে হবে, আর সে কাজটি ক্লাবকেই করতে হবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাফুফে সেখানে সহযোগিতা করতে পারে মাত্র। তবে মিঃ সালাউদ্দিনের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বেশিরভাগ ক্লাব। তাদের বক্তব্য নিয়মিত টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে ব্যর্থ হলে আর্থিক বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পাবে না স্পন্সররা।

ফলে ফুটবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন ক্লাব ফুটবলের খোলনলচে বদলে না ফেললে বাংলাদেশে ফুটবলের সুদিন ফিরবে না।