অনিশ্চয়তায় গাজীপুরে আজ ভোট

প্রকাশিত: ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৬, ২০১৮

অনিশ্চয়তায় গাজীপুরে আজ ভোট

রফিক মৃধা : অনিশ্চতার মধ্যে আজ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একযোগে ভোটগ্রহণ চলবে। সোমবার কেন্দ্রে কেন্দ্রে নির্বাচনি মালামাল পৌঁছে গেছে। নগরীর রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা গাড়ির বহর নিয়ে সাইরেন বাজিয়ে টহল দিচ্ছেন। প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তায় মাঠে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১২ হাজার সদস্য। নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রার্থী ও ভোটাররা। : বিএনপির অভিযোগ, তাদের নেতাকর্মী ও এজেন্টদের গ্রেফতার ও নানাভাবে ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে। নির্বাচনের আগে রবিবার মধ্যরাতেই ১৮ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ সত্ত্বেও ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে থাকতে বলেছে দলটি। টঙ্গীর আউচপাড়ার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে আশঙ্কায় আছি। ভোটের দিন তারা কী করেন তা আল্লাহ ভালো জানেন। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রমে ভোটারদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিচ্ছে সাদা পোশাকে পুলিশ। গাসিকে যে ভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেখানে জনগণ অবাধে পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে এমন কোন পরিবেশ এখনও দৃশ্যমান নয়। জনগণের মধ্যে ভোট নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা আরও গভীরতর হচ্ছে। এদিকে গতকালও গাজীপুরে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিতসহ ১৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। এছাড়াও গতরাতে শত শত বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। : জানা গেছে, গাজীপুরের পার্শ^বর্তী জেলা-উপজেলা থেকে নৌকার পক্ষে জাল ভোট দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী ও দাগী সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে গাজীপুরে এনে জড়ো করা হচ্ছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা যথারীতি নির্বাচনি এলাকা ত্যাগ করলেও আওয়ামী লীগের বহিরাগত কেন্দ্রীয় নেতা ও ক্যাডাররা এখনো এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সর্বত্র সরকারের ম্যাসেজ প্রতিপালিত হচ্ছে অক্ষরে অক্ষরে। প্রতিটি লোকালয়ে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরির কাজ খুব সুচারুভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এখন পর্যন্ত যতটুকু খবর আমাদের কাছে এসেছে তা গাজীপুরে বাছাই করে করে দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ভোট যদি কিছুটা সুষ্ঠু ও অবাধ হয় ধানের শীষের বিজয় ঠেকাতে পারবে না। আর ভোট যদি নির্বাচন কমিশনের ভাষায় চমৎকার হয় তাহলে ভোট ডাকাতি হবে। ইসির সমালোচনা করে রিজভী বলেন, কয়েক দিন আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন গাজীপুরে খুলনার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। তার মানে খুলনায় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক কারচুপি ও ভোট সন্ত্রাসের যে অভিযোগ করা হয়েছে তার বক্তব্যে সেটিই প্রমাণিত হলো। এবং এই ভোট কারচুপি ও অনিয়ম কমিশন ঠেকাতে পারেনি। এদিকে শুধু খুলনা মার্কা নয়, গাজীপুরে ভোট ডাকাতির সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়তে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে ইসি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। : স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত ৩১ মার্চ তফসিল ঘোষণার ৮৬ দিন পর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ভোটার ও প্রার্থীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। গত ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণের কথা থাকলেও ৩৬ দিন নির্বাচনি কার্যক্রম পরিচালনার পর আইনি জটিলতায় মাঝপথে আটকে যায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। পরে আপিল বিভাগের রায়ের প্রেক্ষিতে এ সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত বড় কোনো সহিংস ঘটনা না ঘটনায় স্বস্তিতে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। : বিএনপির প্রার্থী মো. হাসান উদ্দিন সরকার সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে দলীয় কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ভোট জালিয়াতির আশঙ্কা করেন তিনি। সোমবার রাতেও পুলিশ নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়েছে এবং অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। তবে ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট প্রদান করবেন। গাজীপুর সিটিতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। গাজীপুরের জনগণ উন্নয়নের জন্য নৌকায় ভোট দেবে এটাই তার প্রত্যাশা। একটি পরিকল্পিত নগরী এবং গ্রীন সিটি ও ক্লীন সিটি গড়তে সকলের সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। : স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম (নৌকা) ও বিএনপি মনোনীত মো. হাসান উদ্দিন সরকার (ধানের শীষ)। এর বাইরেও মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইসলামী ঐক্যজোটের ফজলুর রহমান (মিনার), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. নাসির উদ্দিন (হাতপাখা), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. জালাল উদ্দিন (মোমবাতি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কাজী মো. রুহুল আমিন (কাস্তে) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদ (টেবিল ঘড়ি)। নির্বাচনি প্রচারণায় ভোটারদের টানতে মেয়র প্রার্থীরা সব চেষ্টাই করেছেন। দিয়েছেন নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি। : এ সিটি করপোরেশনে ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬জন ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৫ জন ও নারী ভোটার ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১ জন। এ নগরীতে নতুন ভোটার ১ লাখ ১১ হাজার। এছাড়া শ্রমিক ভোটার দুই লাখের বেশি। নির্বাচনে নারী, নতুন ও শ্রমিক ভোটাররাই প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় নেতারা। : গণগ্রেফতারের অভিযোগ বিএনপির : পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করতে উচ্চ আদালত ও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের পরও গাজীপুরে নির্বাচনি গ্রেফতার থামছে না। গতকাল সোমবার সন্ধ্যার পর থেকেই আবারো ধরপাকড় শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এক দিন আগে নগরজুড়ে গ্রেফতারের অভিযোগ করেছে বিএনপি। গতকাল সোমবার দুপুরে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের কাছে এ সংক্রান্ত তিনটি অভিযোগ জমা দিয়েছে দলটি। নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মো. সোহরাব উদ্দিন ও জেলা বিএনপির উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সহিদুজ্জামান এ অভিযোগ দেন। অভিযোগে তারা বলেন, পুলিশের অভিযানের মুখে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীসহ সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রবিবার রাতে ডিবি পরিচয় দিয়ে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনার কমিটির ১৮ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। গ্রেফতারকৃতদের কারোর বিরুদ্ধেই কোনো মামলা নেই। এছাড়া ধানের শীষ প্রতীকের মিডিয়া সেলের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. মাজহারুল আলম জানান, ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মী-সমর্থকদের তালিকা ধরে টার্গেট করে গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। এতে নেতাকর্মীরা ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। : তিনি আরও জানান, পুলিশ নেতাকর্মীদের বাড়ির গেট ও দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গ্রেফতার করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, যাদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে কোন মামলা ছিল না তাদেরকে ধরে ভিন্ন জেলা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। দুই-তিন দিন পর কাউকে টাঙ্গাইল, কাউকে নারায়ণগঞ্জ ও কাউকে ঢাকার জেলখানায় পাওয়া যাচ্ছে। তাদের প্রত্যেককে অন্য জেলার একাধিক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে দেয়া হচ্ছে। এই গ্রেফতার অভিযানে গাজীপুর ডিবি পুলিশের সঙ্গে জেলার সকল থানা ও পাশর্^বর্তী জেলাসমূহের পুলিশ নামানো হয়েছে। : কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩৩৮ প্রার্থী: ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত। ৫৬টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ২৫৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে বড় অংশই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এ পদে নির্দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও প্রচার প্রচারণায় দলীয় পরিচিত বড় হয়ে উঠে এসেছে। ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডে মো. মাজহারুল ইসলাম কাউন্সিলর পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ওয়ার্ডটিতে ভোটগ্রহণ হবে না। এছাড়া সংরক্ষিত ১৯টি ওয়ার্ডে ৮৪ জন নারী কাউন্সিলর নির্বাচন করছেন। : জানা গেছে, নির্বাচনের শুরুতে কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন দেয়া হলেও পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। অপরদিকে বিএনপির কাউন্সিলর পদে কাউকে সমর্থন দেয়নি দলটি। দুই দলের নেতারা কাউন্সিলর পদে প্রতিযোগিতা করছেন। : ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৩৩৭টি: গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের ৩৩৭টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভোটকেন্দ্রের পাহারায় ২৪ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হবে। বাকি ৮৮টি সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ২২ জন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থাকবেন। : গাজীপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও ধানের শীষ প্রতীকের প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট দিনকালকে বলেন, ‘আমাদের পোলিং এজেন্টদের নানা ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। তাদেরকে ভোট কেন্দ্রে না যেতে হুমকিও দেয়া হচ্ছে। আমরা নির্বাচন নিয়ে ভীতিতে আছি। এছাড়া আমাদের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বাসায় বসে এজেন্টদের খোঁজখবর রাখছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীদের হুমকি প্রতিহত করতে তিনি (হাসান সরকার) তাদের আশ্বস্ত করছেন। : সর্বশেষ গাজীপুর সিটিতে ২০১৩ সালের ৬ জুলাই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত অ্যাডভোকেট আজমত উল্ল্যাহ খানকে হারিয়ে বিএনপির সমর্থিত অধ্যাপক এম এ মান্নান ১ লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন। এবার এ দু’জনের কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির হাসান সরকার। গাজীপুর সিটিতে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে মেয়র নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট