বিএনপির ইফতার পার্টিতে হাহাকার, কারাগারে যেভাবে খালেদার সেহরি-ইফতার

প্রকাশিত: ১২:২২ পূর্বাহ্ণ, মে ২০, ২০১৮

বিএনপির ইফতার পার্টিতে হাহাকার, কারাগারে যেভাবে খালেদার সেহরি-ইফতার

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দল প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া ইফতার পার্টি অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশের রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির।

শনিবার রাজধানীর ইস্কাটনে ঢাকা লেডিজ ক্লাবে রাজনীতিকদের সম্মানে বিএনপির ইফতার মাহফিলে মিলন মেলা বসেছিল রাজনীতিবিদদের। তবে অনুষ্ঠানজুড়ে এক ধরনের হাহাকার তথা শূন্যতা বিরাজ করছিল।

কেননা, দল প্রতিষ্ঠার পর জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় দুজনে এক সঙ্গে দলের ইফতারে যোগ দিতেন। এরপর জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর প্রতিবছর দলের ইফতার পার্টিতে খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকতেন। ওয়ান ইলিভেনে কারাবন্দি হওয়ার পর একবার দলের ইরতার হয়নি।

এছাড়া প্রতি বছর রমজানে দলের ইফতার পার্টিতে খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকতেন। রাজনীতিবিদদের মিলন মেলায় শুভেচ্ছা জানাতেন খালেদা জিয়া। কিন্তু এবার একেবারেই ব্যতিক্রম। সবাই ছিলেন শুধু নেই খালেদা জিয়া। এ যেন অনুষ্ঠানজুড়ে এক ধরনের হাহাকার তথা শূন্যতা বিরাজ করছিল। এই শূন্যতা কমবেশি সবাই অনুভব করেছেন। সেটাও ফুটে উঠেছে সবার বক্তব্যে।

রাজধানীর ইস্কাটনে ঢাকা লেডিজ ক্লাবে রাজনীতিকদের সম্মানে বিএনপির ইফতার মাহফিলে দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গণতন্ত্র উদ্ধার ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া আমাদের মাঝে নেই। সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় তাকে কারাগারে ইফতার করতে হচ্ছে। দেশের এই দুঃসময়ে, গণতন্ত্রের সংকটে আমরা সবাই প্রত্যাশা করি, আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাদের মূল্যবান অবদান রাখবেন। জাতিকে এই সংকট উত্তরণে তারা নেতৃত্ব দেবেন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা একথা সব সময় বলে আসছি এবং আমরা বিশ্বাস করি- এই সময়ে জাতীয় ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। গণতন্ত্র উদ্ধার, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রতি আমাদের উদাত্ত আহ্বান থাকবে- আসুন দেশের এই প্রয়োজনে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।’

ইফতার মাহফিলে আরও উপস্থিত ছিলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সহ-সম্পাদকরা এতে উপস্থিত ছিলেন।

ইফতার অনুষ্ঠানে দেওয়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি বি চৌধুরী।

তিনি বলেন, আজকে বিএনপির নেতারা বেশি না হলেও কর্মীদের ভয়ে বুক কাঁপে দুরু দুরু করে। কাঁপবে না কেন? তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। কি হবে যদি আবার সরকারি দল ক্ষমতায় আসে- এবারে আমাদের কি হবে? এটা স্বাভাবিক শঙ্কা। অভিজ্ঞতায় বলে খুব সুবিধা হবে না।

তিনি বলেন, একইভাবে সরকারের কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মী আমার কাছে আসছেন তাদেরও বুক কাঁপে। যদি বিএনপি আসে তাহলে তাদের কি হবে? এটা কী খুব ভালো কথা, এটা কী রাজনীতির জন্য শুভ, এটা কী দেশের ভবিষ্যতের জন্য শুভ? এটা কী ইংগিত নয় যে, আবার একটা পর্যায় যেতে পারে দেশ, যেখানে মানুষ মানুষকে হত্যা করে, নিগৃহিত করবে, জেলে দেবে, আগুন জ্বালিয়ে দেবে। কিন্তু থামাবে কে? আমি চিন্তার খোরাক দিয়ে গেলাম।

তিনি বলেন, এমন একটা শক্তি দরকার যে ওদিকেও কনট্রোল করতে পারে, এদিকেও কনট্রোল করতে পারে। তারা যদি উঠে আসতে পারে। বলে দেয়- তোমরা যদি একটা মানুষের গায়ে হাত দাও তাহলে সমর্থন উইথড্র করব, গোল্লায় যাও, বিরোধী দলে যাও। একমাত্র তাহলেই দেশ রক্ষা পেতে পারে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় পার্টি (জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, জামায়াতে ইসলামীর নেতা মিয়া গোলাম পরোয়ার, নুরুল ইসলাম বুলবুল, আবদুল হামিদ, এলডিপি মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, কল্যাণ পার্টি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, খেলাফত মজলিশের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান, মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের, মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমান, বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া, এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, এনডিপি চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা, জাগপা সভাপতি রেহেনা প্রধান, সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লোতফর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের (একাংশ) চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রকিব, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সভাপতি মুফতী মুহম্মদ ওয়াক্কাস, মুসলিম লীগের সভাপতি এ এইচ এম কামারুজ্জামান, পিপলস্ লীগ মহাসচিব সৈয়দ মাহবুব হোসেন, ডিএল সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, লেবার পার্টির (একাংশ) চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, লেবার পার্টির (অপরাংশ) চেয়ারম্যান এমদাদুল হক চৌধুরী, মহাসচিব হামদুল্লাহ আল মেহেদী, ন্যাপ ভাসানী সভাপতি অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাঈদ আহমেদ, ইসলামিক পার্টির সভাপতি আবু তাহের চৌধুরী প্রমুখ।

কারাগারে খালেদার সেহরি-ইফতার
কারান্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থতার কারণে রোজা বাদ দিতে চান না। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে সেহরি খেয়ে তিনি এই রমজানের প্রথম রোজা রাখেন। তাকে সেহরিতে ভাত মাছ, মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল দেয়া হয়। এসব তথ্য জানান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরাণীগঞ্জের সহকারী সার্জন ডা. মো. মাহমুদুল হাসান শুভ। তিনি এখন কারাগারে প্রায় প্রতিদিন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যগত দিক দেখাশুনা করছেন। তার খাবারও তিনি দেখে দেন বলে জানা গেছে।

ডা. শুভ বলেন, তার অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে। তিনি প্রায় সব রোজা রাখতে চান। রোজা ছাড়ার ইচ্ছা তার নেই। প্রথম সেহেরিতে যে ভাত, মাছ, মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল দেয়া হয়েছে; সেখান থেকে অল্প খাবার খেয়ে তিনি রোজা রেখেছেন। তাকে দেয়া সব খাবার তিনি খাননি। রোজা রাখতে তার কোনো অসুবিধা নেই বলেও মন্তব্য করেন ডা. শুভ।
ইফতারির বিষয়ে তিনি বলেন, ইফতারের তালিকায় রয়েছে ছোলা, মুড়ি, খেজুর ও ফল থাকছে। তা খেয়েই তিনি রোজা ভাঙছেন।

কারাসূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাত ৩টায় খালেদা জিয়াকে সেহেরি খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে জাগানো হয়। এরপর তিনি হাত-মুখ ধোয়ে খাওয়ার জন্য তৈরি হন। পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে তার কক্ষে দেখাশুনার দায়িত্বে রয়েছেন সিনিয়র কারারক্ষী মাহফুজা। গত ১২ মে থেকে ডেপুটি জেলার শিরিন সরকারি প্রশিক্ষণে দক্ষিণ কুরিয়ার থাকায় তার পরিবর্তে মাহফুজা ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে রয়েছেন। সঙ্গে রয়েছেন আরো কয়েজন নারী ও পুরুষ কারারক্ষী। তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে খাবারের আয়োজন এনে দেন। এরপর তিনি সেহেরি খেয়ে রোজা রাখেন।

কারা অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স-সদর দপ্তর) মো. বজলুর রশিদ বলেন, জেল কোড অনুযায়ী একজন ডিভিশনপ্রাপ্ত ভিআইপির প্রাপ্য খাবার তাকে দেয়া হচ্ছে। সেহেরি ও ইফতারে তা খেয়ে তিনি রোজা রাখছেন।
ইফতারি নিয়ে কারাফটক থেকে ফেরত বিএনপি নেতাকর্মীরা: এদিকে শুক্রবার বিকালে চেয়ারপারসনের জন্য ইফতারির ডালা নিয়ে নাজিম উদ্দিন রোডের পুরোনো কারাগারে যান বিএনপির নেতাকর্মীরা। অনুমতি না থাকায় কারা ফটক থেকে তাদের ফেরত দেন কারাকর্তৃপক্ষ। সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। ইফতারের ডালাও গ্রহণ করা হয়নি।

শুক্রবার বিকাল আড়াইটার দিকে বেশ কয়েকটি ইফতারের ডালা নিয়ে নাজিম উদ্দিন রোডে কারা ফটকের কাছে যান জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের অন্তত ১৫ নেত্রী। তাদের অধিকাংশের হাতেই বিভিন্ন রকমের ফলের ডালা। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির মহিলা দলের সধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ। প্রধান ফটকের আগেই তারা পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। এরপর তারা প্রথমে নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ চান। তা পাওয়া না গেলে তাদের নেয়া ফলমুলগুলো পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ জানায়।

দায়িত্বরত প্রধান কারারক্ষী আল হাসান মোবাইল ফোনে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানায়। তাতে সম্মতি পাওয়া না গেলে তিনি তাদের মুখোমুখি হন। বলেন, আপনারা দলের নেতাকর্মী। আসতেই পারেন। কিন্তু তার পরিবারের কোনো সদস্য ছাড়া তার জন্য খাবার নেয়া যাবে না। তার নিরাপত্তার স্বার্থেই তা সম্ভব নয়। আর আপনারা যদি সাক্ষাৎ করতে চান তাহলে আগামী রোববার অনুমতির জন্য আবেদন করেন। অনুমতি পাওয়া গেলে দেখা করতে পারবেন।

মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের মা তিন মাসের বেশি সময় ধরে জেলে। আজ প্রথম রমজান। তিনি কী খাচ্ছেন জানি না। আমরা আমাদের মা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য ইফতার সামগ্রী নিয়ে এসেছিলাম। সাক্ষাৎ করতে দেয়া না হলেও তা আমাদের মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হোক। এ সময় একাধিক নেত্রী বলেন, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাড়ে ৩৯টাকায় কী ইফতার করবেন। আমাদের ইফতার সামগ্রী পৌঁছে দিলে কী হয়। উল্লেখ্য, জেল কোড অনুযায়ী একজন ডিভিশনপ্রাপ্ত ভিআইপির ইফতারের জন্য বরাদ্দ সাড়ে ৩৯ টাকা।

এ সময় জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পেয়ে ইফতার সামগ্রী নিয়ে ফিরে যান বিএনপি নেতাকর্মীরা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নূরে আলাপ সাফা, সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আখতার, ঢাকা উত্তর মহানগর বিএনপির সভানেত্রী পিয়ারা মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম।

এরপর বিকাল সোয়া তিনটার দিকে একটি ভ্যানগাড়ি বোঝাই ইফতারের ডালা নিয়ে কারাগারে যান ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. ডন মো. সালাহ উদ্দিন ও বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। তারাও পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। কিছুক্ষণ চেষ্টা তদবির করে অবশেষে ভ্যানগাড়িসহ ফিরে যান তারাও। এ সময় সঙ্গে ছিলেন ঢাকা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল কবির পল, যুগ্ম সম্পাদক মো. মাসুদ পারভেজসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী।

প্রসঙ্গত, গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডের আদেশের পর থেকে ওই কারাগারে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে বিগত ৩ মাস ১০ দিন ধরে তিনি কারান্তরীণ। গত বুধবার হাইকোর্টের আপিল বিভাগে এই মামলায় তার জামিন হলেও আরো বেশ কয়েকটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ফলে ঠিক কবে নাগাদ তার মুক্তি মিলবে তা নিশ্চিত নয়।

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট