সুরঞ্জিতের মৃত্যুতে বিভিন্ন মহলের শোক, শেষকৃত্য সোমবার তিনটায়

প্রকাশিত: ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৭

সুরঞ্জিতের মৃত্যুতে বিভিন্ন মহলের শোক, শেষকৃত্য সোমবার তিনটায়

নিজাম ইউ জায়গীরদার ।। প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেছেন।  তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহল গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। প্রয়াত সুরঞ্জিতের শেষকৃত্য সোমবার তিনটায় অনুষ্ঠিত বলে জানা গেছে।

রবিবার ভোর ৪টা ২৪ মিনিটের দিকে তিনি মারা যান বলে জানিয়েছেন রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এর আগে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফসাপের্টে রাখা হয়।

জানা গেছে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। শুক্রবার অবস্থার অবনিত হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরীণ শারমীন চৌধুরীসহ বিভিন্নি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সকালে সাংবাদিকদের বলেন, এখন আমরা তাকে শেষ বিদায়ের প্রস্তুুতি নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী ও পার্টির সভাপতি শেখ হাসিনা, পরিবারের লোকজন এবং তার ঘনিষ্ট লোকদের সাথে আলোচনা করে প্রোগ্রাম ঠিক করেছি। শিডিউলটা হচ্ছে প্রথমে তার মরদেহ সকাল ৯ টায় জিগাতলায় তাঁর বাসভবনে যাবে। দুপুর ১২ টায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হবে। বিকাল ৩ টায় জাতীয় সংসদ ভবনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন হবে।

এরপর সংসদের অফিসিয়ালি কিছু নিয়ম আছে সেগুলো করা হবে। এরপর তাকে আজকের মত মরদেহ হিমঘরে রেখে দেওয়া হবে। আগামীকাল সোমবার সকাল ৯ টায় মরদেহ সিলেট নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে সকাল ১০টা ১১ টা পর্যন্ত সিলেটে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। ১১ টায় মরদেহ সুনামগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হবে। সুনামগঞ্জ থেকে ১টায় তার নির্বাচনী এলাকা দিরাইয়ের সালনা নিয়ে যাওয়া হবে। এবং তিনটায় তার ইচ্ছা অনুযায়ী দিরাইতে শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে।

বর্ণাঢ্য জীবন

বহুদিন থেকেই সেই তেজোদীপ্ত বক্তব্য নেই বর্ষীয়ান রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। স্বভাবসুলভ টিপ্পনী আর চাঁছাছোলা বক্তব্য বহুদিন ধরে গণমাধ্যমে আসে না। সুরঞ্জিত রাজনীতিতেও আর সেভাবে সক্রিয় ছিলেন না। মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে আসা ছবিতে দেখা যায়, শরীরের ওজন অনেকটাই হারিয়েছেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ। বুঝাই যাচ্ছিল তার শরীরে বাসা বেঁধেছে জটিল রোগ।

যত দূর জানা গেছে, তার সমস্যা ফুঁসফুস ও রক্তে। ক্যান্সারের আগের পর্যায়ে ছিল সেটি। এ কারণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তেমন অংশ নিতেন না তিনি। অনেকটা হারিয়ে ফেলেছিলেন মানসিক শক্তিও।

সুরঞ্জিতের ঘনিষ্ঠজনদের সূত্রে জানা গেছে, তার রক্তের হিমোগ্লোবিনে সমস্যা ছিল। এ কারণে ১৫ দিন অন্তর এক ব্যাগ রক্ত দিতে হতো। রক্তের গ্রুপ ‘ও পজিটিভ’। পরিচিতজনদের মধ্য থেকেই এই রক্ত নেয়া হতো। এ জন্য একটি গ্রুপও খুলেছিলেন তারা। তিনি গত দুই বছরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে একাধিকবার চিকিৎসা করিয়েছিলের। নিয়মিত ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেন।

সবশেষ ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে হোঁচট খেয়ে ব্যথা পান সুরঞ্জিত। এই ঘটনাতেও তিনি তিন দিন হাসপাতালে ছিলেন।

এরপর ফের গত শুক্রবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্তনের ফুসফুসের সমস্যায় হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। পরে শনিবার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটায় তাকে সিসিইউতে রাখা হয় হয়।

বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিতের রাজনীতির শুরু বামপন্থী সংগঠনে। সাম্যবাদী দর্শনে দীক্ষা নিয়ে ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক জীবন শুরু করা এই নেতা দীর্ঘ ৫৯ বছর দাপটের সঙ্গেই চলেছেন।

রাজনৈতিক জীবনের কঠিনতম সময়ে কাউকে পাত্তা দিয়ে চলেননি সুরঞ্জিত। দুর্দান্ত সাহস দেখিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অর্জন করেছেন বহু সম্মান। তবে শেষ জীবনে রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন।

সাম্যবাদী দর্শনে দীক্ষা নিয়ে ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এই প্রবীণ নেতা। স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদ সদস্যসহ চার দশকের বেশির ভাগ জাতীয় সংসদেই নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন সুরঞ্জিত। তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।

নবম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কমিটিরও কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আনোয়ারপুর গ্রামে জন্ম সুরঞ্জিতের। তার বাবা চিকিৎসক দেবেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মা সুমতি বালা সেনগুপ্ত। তিনি দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেট এম সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সন্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

দেশের এই প্রবীণ রাজনীতিক ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।

সত্তরের ঐতিহাসিক প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সময়ও ন্যাপ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৯, ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বামপন্থী সুরঞ্জিত ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

তিনি মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ও আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিহিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিণী ড. জয়া সেনগুপ্ত একটি বেসরকারী সংস্থায় দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন। একমাত্র পুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত একজন আইটি প্রকৌশলী, বর্তমানে একটি বেসরকারী কোম্পানিতে কর্মরত।

মন্ত্রিত্বপ্রাপ্তি ও বিতর্ক

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একবারই মন্ত্রিত্বের স্বাদ পান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তবে ২০১২ সালে রেলপথ মন্ত্রী হওয়ার অভিজ্ঞতা অবশ্য সুখকর ছিল না। রেলের উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিলেও মন্ত্রীর একান্ত সহকারী ওমর ফারুক ৭০ লাখ টাকাসহ আটক হওয়ার পর ওঠা বিতর্কের পর মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। আটক হওয়া কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন, ওই টাকা তিনি সুরঞ্জিতের বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে পরে তদন্তে এই দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। যদিও সুরঞ্জিতের রাজনৈতিক জীবনে এটাই সবচেয়ে কালো অধ্যায় হিসেবে ধরা হয়।

পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় পদত্যাগকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজেই মন্তব্য করেছিরেন, ‘এটা তার রাজনীতিতে ‘যাত্রাবিরতি’।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট