স্থলপথে বাংলাদেশি পণ্যে নিষেধাজ্ঞার কারণ জানাল ভারত

প্রকাশিত: ১০:২৭ অপরাহ্ণ, মে ১৮, ২০২৫

স্থলপথে বাংলাদেশি পণ্যে নিষেধাজ্ঞার কারণ জানাল ভারত

বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে পণ্য আমদানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত। শনিবার (১৭ মে) দেশটি জানায়, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্য আর স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ কয়েকটি রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।

এ নিষেধাজ্ঞা মূলত পোশাকসহ কয়েকটি জনপ্রিয় পণ্যের ওপর কার্যকর হবে, যা ভারতীয় আমদানিকারকদের এখন বাধ্যতামূলকভাবে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে বাধ্য করবে।

ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করছে গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)। এ পরিমাণ বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে মোট রপ্তানির প্রায় ৪২ শতাংশ।

রোববার (১৮ মে) ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ি, আর আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সীমান্ত শুল্ক পয়েন্টগুলো দিয়ে এখন থেকে ফলমূল, কার্বনেটেড পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, তুলার বর্জ্য, কাঠের আসবাবপত্র ও নির্দিষ্ট কিছু প্লাস্টিক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

জিটিআরআই বলছে, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্ত কেবল অর্থনৈতিক নয়, এতে কূটনৈতিক বার্তাও নিহিত। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, বাংলাদেশ সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ভারত এ পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে ‘সমুদ্রপথ থেকে বিচ্ছিন্ন’ বলে অভিহিত করেন। সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ২.১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়। বিষয়গুলো ভারতের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে প্রভাব ফেলেছে বলে জিটিআরআই মনে করছে।

এএনআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ গত এক বছরে ভারতীয় সুতা, চাল, কাগজ, মাছ, গুঁড়া দুধ এবং তামাকজাত পণ্যের আমদানিতে একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে এসব পণ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হবে।

তাছাড়া বাংলাদেশ তাদের ভূখণ্ড দিয়ে ভারতের পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে টনপ্রতি ১.৮ টাকা করে ট্রানজিট ফি আরোপ করেছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, এসব পদক্ষেপে ভারতের রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং এটি ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করছে’।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে ভারতে। এতদিন এসব পণ্য মূলত স্থলবন্দর দিয়ে যেত। কিন্তু ভারতের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে কেবল কলকাতা ও নাভা শেভা (মহারাষ্ট্র) বন্দরের মাধ্যমে এসব পোশাক আমদানি করতে পারবে ভারতীয় ক্রেতারা।

জিটিআরআই বলছে, এতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে সময় ও খরচ উভয়ই বাড়বে, ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সংস্থাটি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ভারতের এই পদক্ষেপ সরাসরি বাংলাদেশি সুতা আমদানিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার জবাব।

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে নতুন উত্তেজনার ইঙ্গিত স্পষ্ট। দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক বাধা সৃষ্টির অভিযোগ করছে। ফলে ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আরও জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

উল্লেখ্য শনিবার (১৭ মে) ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও পোশাকসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরই প্রেক্ষিতে ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা গার্মেন্টস পণ্যবোঝাই ৩৬টি ট্রাক বর্তমানে বেনাপোল বন্দরে আটকে আছে। এতে দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্থলপথে ভারতীয় সুতা আমদানিতে এক মাস আগে নিষেধাজ্ঞা দেয় বাংলাদেশ, এর জবাবে এ নিষেধাজ্ঞা দিল ভারত। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফটি) ১৭ মে এক আদেশে জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। এতে আরও বলা হয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও গার্মেন্টস পণ্য এখন থেকে শুধু কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করা যাবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতকে প্রায় ১৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে, আগের অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে ১১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকার পণ্য।

ভারত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৭০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এর মধ্যে প্রায় ৯৩ শতাংশই যায় স্থলপথে। ফলে নতুন নিষেধাজ্ঞা গার্মেন্টস খাতে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, “যেসব পণ্যের এলসি ও টিটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলো যেন ছাড়া যায়, সে বিষয়ে কাস্টমসের সঙ্গে আলোচনা চলছে।”

বেনাপোলের কয়েকজন রপ্তানিকারক জানান, স্থলপথে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা কার্যত রপ্তানি বন্ধ করে দেবে। তাদের পক্ষে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠানো সম্ভব নয়, কারণ এতে সময় ও খরচ দুই-ই অনেক বেড়ে যায়।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, “স্থলপথে গার্মেন্টস পণ্য পাঠাতে খরচ অনেক কম হতো। এখন সমুদ্র কিংবা আকাশপথে পাঠাতে খরচ অনেক বেড়ে যাবে।”

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক লতা বলেন, “বছরে ১০ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয় ভারতে। সহজ যোগাযোগের কারণে বেশিরভাগ আমদানিকারক বেনাপোল বন্দর ব্যবহার করে থাকেন। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, গার্মেন্টস, কেমিকেল, বসুন্ধরা টিসু, মেলামাইন ও মাছ।”

বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার বলেন, “আমরা এখনো এ বিষয়ে কোনো অফিসিয়াল চিঠি পাইনি। পত্রিকায় বিষয়টি দেখেছি। শনিবার পর্যন্ত সব ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে রোববার সকাল থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও গার্মেন্টস জাতীয় কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি, ৩০-৩৫টি ট্রাক বন্দরে আটকে আছে।”


 

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট