বাংলাদেশে হাসপাতালই করোনার বড় উৎস?

প্রকাশিত: ১২:২৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৮, ২০২০

বাংলাদেশে হাসপাতালই করোনার বড় উৎস?

Manual1 Ad Code

বাংলাদেশে করোনায় চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা উচ্চহারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো পুরো বা আংশিক লকডাউন করতে হচ্ছে করোনার কারণে। এমন পরিস্থিতি হওয়ার কারণ কী?

হাসপাতালগুলো লকডাউন হওয়ার তিনটি কারণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের পরিস্থিতি বেশি খারাপ বলে তারা জানান। বেসরকারি কোনো কোনো হাসপাতালে চিকিৎসকদের পিপিই পরতে দেয়া হয় না বলেও অভিযোগ আছে। ওইসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মনে করে, চিকিৎসকরা পিপিই পরলে রোগীরা ভয় পান।

সার্বিকভাবে হাসপাতালের এই পরিস্থিতির প্রধান তিনটি কারণ হলো, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, নিম্ন মানের পিপিই এবং এবং রোগীদের তথ্য গোপন করার মানসিকতা। আবার পিপিই থাকলেও অনেক চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী এর সঠিক ব্যবহার জানেন না।

হাসপাতাল লকডাউন

গত ২৩ এপ্রিল ঢাকার বারডেম হাসপাতালের আইসিইউ লকডাউন করে আইসিইউর সব চিকিৎসক ও নার্সকে হোম কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়। হাসপাতালের আইসিইউতে এক রোগী করোনা ভাইরাসের লক্ষণ গোপন করে ভর্তি হয়েছিলেন। আর তার ফলাফল হলো আইসিইউতে থাকা সাত রোগীই এখন করোনায় আক্রান্ত। এ কারণে আইসিইউ লাকডাউন করে সেখানকার সব চিকিৎসক ও নার্সকে হোম কোয়ারান্টিনে পাঠাতে বাধ্য হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এর আগে ৯ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের একটি ইউনিট লকডাউন করা হয়। ওই ইউনিটে চিকিৎসাধীন একজন করোনায় মারা গেলে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়।

ইনসাফ বারাকাহ নামের একটি বেসরকারি কিডনি হাসপাতাল লকডাউন করা হয় ১৪ এপ্রিল। চিকিৎসক-নার্সসহ ৯ জন করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এই ব্যবস্থা নিতে হয়। এছাড়া ঢাকার আনোয়ার খান ও ল্যাবএইডসহ বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল আংশিক লকডাউন করা হয়। সর্বশেষ আংশিক লকডাউন করা হয়েছে বিআরবি হাসপাতাল।

Manual2 Ad Code

ঢাকার বাইরে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল লকডাউন করা হয় ২৬ এপ্রিল। এর বাইরে কয়েকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও লকডাউন করা হয়েছে৷ তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কতগুলো হাসপাতাল পূর্ণ বা আংশিক লকডাউন হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ)-এর হিসেবে ঢাকায় সাতটি এবং ঢাকার বাইরে দুটি হাসপাতাল এ পর্যন্ত আংশিক ও পুরো লকডাউন করা হয়েছে।

আক্রান্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসেসিয়েশন (বিএমএ)-এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী সরকারি হিসেব উল্লেখ করে জানান, সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৬৪৪ জন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে চিকিৎসক ২৮৯ জন। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। ঢাকা বিভাগের ঢাকায় ১২৩ জন, কিশোরগঞ্জে ৫৩, গাজীপুরে ১৪, নারায়ণগঞ্জে ১৪, নরসিংদীতে ৪, মানিকগঞ্জে ২, মাদারীপুরে ২ এবং গোপালগঞ্জে ১ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। সারাদেশে মোট নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ১১২ জন। ঢাকা বিভাগেই বেশি। এর বাইরে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন ২৪৩ জন।

Manual5 Ad Code

তবে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন(বিডিএফ)-এর প্রধান সমন্বয়কারী ডা. নিরুপম দাস এই সংখ্যার সাথে ভিন্নমত পোষন করেন। তিনি বলেন,‘আমরা যে তথ্য সংগ্রহ করি নিয়মিত, তাতে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ৩৭৩ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন একজন। সুস্থ হয়েছেন আট জন। নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ২২০ জন। সুস্থ হয়েছেন ছয় জন।

‘বাকি পিপিই কোথায় গেল?’

Manual8 Ad Code

চিকিৎসকরা প্রধানত নিম্নমানের পিপিই’র কারণে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান বিএমএ’র সাবেক মহাসচিব এবং স্বাচিপ-এর সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সালান খান। তিনি বলেন,‘এর সঙ্গে আছে পিপিই ব্যবহার করতে না জানা। মান সম্পন্ন পিপিই থাকলেও তা ব্যবহারের নিয়ম না জানলে কোনো লাভ নেই। এ নিয়ে আমাদের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আগে থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি আগে।’

তিনি আরো বলেন,‘সামাজিক স্টিগমার কারণে অনেক করোনা আক্রান্ত তার লক্ষণ গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ কারণে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতাল লকডাউন করতে হয়েছে।’

বিএমএ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন,‘এখন প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার পর ভালো পিপিই বিতরণ হচ্ছে।’

Manual1 Ad Code

তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন,‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত এক লাখ ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ১৩ লাখ পিপিই বিতরণের কথা বলা হয়েছে। তাহলো তো গড়ে ১৩টা করে পিপিই পাওয়ার কথা। কিন্তু পিপিই’র তো এখনো সংকট আছে। ওই পিপিইগুলো তাহলে কোথায় গেল?’

তিনি বলেন,‘ব্র্যাক ইউনিভার্সিাটর জরিপে দেখা গেছে, এখানো ২৫ ভাগ চিকিৎসক পিপিই পাননি। ৪০ ভাগ নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী এখনো পিপিই পাননি।’

ডা. নিরুপম দাস এর সঙ্গে যোগ করেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং অধিক সংখ্যক চিকিৎসককে একসঙ্গে কাজে লাগানোর কারণে তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আগে থেকে পরিকল্পনা না থাকায় এটা হয়েছে।’

তিনি বলেন,‘আর বেসরকারি হাসপাতালে তো পিপিই দেয়া হয় না। নিজেদের কিনে নিতে বলে৷ করোনায় আক্রান্ত হলে তারা, লকডাউন করতে চায় না, কারণ তাহলে অন্য রোগী পাবে না। এমনকি কোনো কোনা বড় প্রাইভেট হাসপাতাল চিকিৎসকদের পিপিই পরতে দেয় না। পিপিই পরলে রোগী ভয় পাবে এবং কমে যাবে বলে তারা মনে করে। তারা তাদের ব্যবসা দেখছে। আবার রোগী কম দেখিয়ে হাসপাতাল চালু রেখে প্রণোদনাও আদায়ের চেষ্টা করে।’

রোগীরা তাদের করোনা উপসর্গ লুকিয়ে হাসাপাতালে চিকিৎসা নিতে যায়, কারণ, উপসর্গের কথা বললে কোনো হাসপাতাল তার চিকিৎসা করবে না এমন একটা ভয় থাকে। একারণে শুরুতেই চিকিৎসায় টায়ার সিস্টেম থাকার দরকার ছিল। সবাইকে করোনা রোগী ধরে তারপর প্রাথমিক পরীক্ষার মাধ্যমে ভাগ করে ফেললে এই সমস্যা হতো না বলে মনে করেন ডা. এহতেশাম।

তিনি বলেন,‘গবেষণায় দেখা গেছে, উহানে ৪০ ভাগ করোনা ছড়িয়েছে হাসপাতাল থেকে। আমাদের এখানেও তা-ই হচ্ছে। চিকিৎসক আক্রান্ত হচ্ছেন, হাসপাতাল লকডাউন হচ্ছে। এখন হাসপাতালই করোনা ভাইরাসের বড় সোর্সে পরিণত হচ্ছে। এটা জরুরিভাবে মোকাবেলা করা দরকার।’

তার মতে,‘করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের আক্রান্তের হার কম। সেটা বিবেচনায় নিয়ে সব হাসপাতালেই একই ধরনের ব্যবস্থাপনা চালু করা যায়।


-সূত্র : ডয়চে ভেলে

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code