ছবির পেছনে ছুটে চলা এক রিমন

প্রকাশিত: ৪:৩৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৯, ২০২৪

ছবির পেছনে ছুটে চলা এক রিমন

উদীয়মান ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ রিমন। শৈশব থেকেই বড় ফটোগ্রাফার হওয়ার ইচ্ছা মনে। তাই সময়ের ব্যবধানে ছবি তোলাটাই তার হয়ে গেছে নেশা। কাঁধে একটা মস্ত ব্যাগ ঝুলিয়ে ছবির পেছনে ছুটে চলে। ছবিকে ছবি করে তোলার ভাবনায় ডুবে থাকা। একটি ভালো ছবি তুলতে পারলে মনের ভিতর অন্য রকম সুখ অনুভব। একটি মান সম্পন্ন ছবি মানে অন্যরকন অনুভুতি। ছবি তোলার প্রতি এক অদম্য নেশায় সারাক্ষণ ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে খুঁজেন সেই বিষয় বস্তু যা সকল স্মৃতির উর্ধ্বে গিয়ে গ্রহণ করবে আপামর মানুষের ভালোবাসা। মনে হয় না সৃষ্টিশীল কাজ কোন শিল্পী পরিচিতি লাভ অথবা পুরষ্কার প্রাপ্তির আশায় করেন। ফটোগ্রাফি এমন একটা বিষয় যা মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, নদী, পাহাড়, সাগর তথা প্রকৃতির সকল স্থানে বিচরন করে। সময় নিয়ে ঘুরে ফিরে তিরু দৃষ্টি দিয়ে ছবি তোলার বিষয় খুঁজে বের করতে হয়। তারপর বিষয় বস্তু টের পাওয়ার আগে, বিষয়কে খুব দ্রুত কম্পোজিশন করে স্বল্প সময়ের মধ্যে ক্যামেরা বন্দী করতে হয়। এখানেই ফটোগ্রাফি অন্য ভিজুয়াল মাধ্যমের চেয়ে আলাদা বা স্বতন্ত্র। সিলেট নগরীর নাইওরপুলের এক মুসলিম পরিবারে জন্ম খ্যাতনামা তরুণ আলোকচিত্রী মোহাম্মদ রিমনের। জন্ম ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সাল ইসমাইল মঞ্জিল নাইওরপুল সিলেট, পিতা মরহুম আব্দুল মোতাহির বাচ্চু মিয়া, মাতা সৈয়দা সুফিয়া বেগম দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মোহাম্মদ রিমন তৃতীয়। সৎ ও স্পষ্টবাদী ব্যতিক্রম চরিত্রের অধিকারী মোহাম্মদ রিমন সবার সাথে খুব একটা মিশেন না। তাঁর হাতেগুনা কিছু ঘনিষ্ট বন্ধু বান্ধব ব্যতিত। তরুণ এই ফটোগ্রাফারের জীবনের গল্প নিয়ে আজকের এ প্রতিবেদন।

শৈশব থেকে নিজের অজান্তেই ছবি তোলার প্রতি ঝুঁকে যান। তিনি সবসময় কাজ করেননি। যখনই ভিতর থেকে একটা টান বা তাড়না অনুভব করেন তখনই ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ছবি তোলার জন্য।

মোহাম্মদ রিমন ১৯৯৬ সাল থেকে নিজের উৎসাহ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় ছবি তোলার জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি সিলেট ফটোগ্রাফি সোসাইটি (এসপিএস) এর সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে মরহুম আলোকচিত্রী ফখরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ রিমন শহীদ সোলেমা হল সিলেট এ যৌথ আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেন। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি সোসাইটি (বিপিএস) গ্যালারিতে রিমন একক আলোচচিত্র প্রদর্শনী করেন। কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ মোহাম্মদ রিমন ২৬ বছরের ছবি তোলার অভিজ্ঞতায় প্রায় ৬০০টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও ৪০টি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। রিমন ২০০২ সালে সাউথ এশিয়ান ইনষ্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি অ্যাডভান্সড (পাঠশালা) কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। ২০০৩ সালে বিপিএস জাতীয় আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তৎকালিন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজ উদ্দিন এর কাছ থেকে বিপিএস প্রথম পুরস্কার সম্মাননা গ্রহণ করেন। বিপিএস এর আয়োজনে ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও মো. লুৎফর রহমান বীনু। ২০০৮ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত ৬৯তম আশাহিশিম্বুন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে গোল্ড মেডেল লাভ করেন। আবার ২০০৮ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত আক্কু ফটো কনটেস্টে অংশ নিয়ে রানারআপ পুরস্কার পান। ২০১০ সালে আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত ফটোক্লাব কুইলমেস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে গ্রান্ড এওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৩ সালে নিক্কন আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় প্রায় ১ লাখ ছবি জমা পড়ে। সেই প্রতিযোগিতায় মোহাম্মদ রিমন দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ২০১৩ সালে ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ফটোগ্রাফি থেকে EFIAP ডিষ্টিংশন অর্জন করেন। ২০১৬ সালে ইমেজ কলিজিয়াস সোসাইটি USA থেকে HON FICS অর্জন করেন। তাছাড়া আরো ৪টি অর্গেনাইজেশন থেকে রিমনকে সম্মাননা জানানো হয়। রিমন ২০২০ সালে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি সোসাইটি থেকে FBPS ফেলোশিপ অর্জন করেন।

মোহাম্মদ রিমনের ২টি ফটোগ্রাফি ছাপা হয়েছে। তন্মধ্যে ১. জাম্প শিরোনামে ছবিটি থেকে যে বার্তা পাওয়া যায় একজন মানুষের বাড়িফেরার অস্থিরতা বা তাড়াহুড়া। যেন জীবনের চেয়ে সময়ের মূল্য অনেক বেশি। একজন মানুষের বাড়ি ফিরার আবেগ তার প্রাণহানির কারণ হতে পারে। ২. যদি আমিও ফুটবল খেলতে পারতাম? শিরোনামে ছবিটি মোহাম্মদ রিমনের ব্যতিক্রমধর্মী একটা কাজ। দুর্ঘটনায় পা হারানো চা শ্রমিক; ক্র্র্যাচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চেয়ে একটি দূরে কয়েকজন বাগানী শিমু ফুটবল খেলছে। এখানে রিমন এমন কৌশল অবলম্বন করে ছবিটি ক্যামেরা বন্দি করেছেন সত্যি বিস্ময়কর। পা হারানো প্রতিবন্দী ব্যক্তি/বা বিষয়ের বডি মোবমেন্ট বলে দিচ্ছে প্রিয় খেলা ফুটবল খেলতে না পারা বেদনা। মোহাম্মদ রিমনের আলোকচিত্রে বেশির ভাগ কাজ বক্তব্যধর্মী। মোহাম্মদ রিমন ভবিষ্যতে বক্তব্যধর্মী আলোকচিত্রি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রিমনের ইচ্ছা এ বছরই সিলেট ও চট্টগ্রামে একক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা। বর্তমানে একক প্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন। পরিকল্পনা আছে তাঁর তোলা ছবি থেকে বাছাইকৃত ছবি দিয়ে ক্যাটালগ করার। আলোকচিত্র পারপাসে তাঁর আয়কৃত সকল অর্থ গরীব-দুঃখী অসহায় মানুষ ও মানবতার সেবায় ব্যয় করবেন বলে জানান রিমন। রিমনের আক্ষেপ বাংলাদেশে আলোকচিত্রীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোন মূল্যায়ন করা হয় না। এ বিষয়ে সাধারণের বোধগম্যের জন্য পাঠ্যপুস্তকেও তেমন কোন মেসেজ নেই বললেও চলে। পূর্ণাঙ্গ আলোকচিত্র প্রদর্শনীল জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কোন গ্যালারী নেই। অথচ বাংলাদেশী আলোকচিত্রীরা বিভিন্ন দেশে আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সম্মান অর্জন করে নিয়ে আসছেন প্রতিনিয়ত। এসব আলোকচিত্রীরা নিজ দেশে যথাযথ মূল্যায়ন পায়নি কোনদিন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, উদিয়মান আলোকচিত্রীদের বিষয়ভিত্তিক মানোন্নয়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোন একাডেমি নেই। তিনি অনুরোধ করে বলেন, সরকার এই দিকটা আমলে নিয়ে একটা সমাধানমূলক বিবেচনা করবেন। বাংলাদেশ, বসনিয়া, সাইপ্রাস ও মেসিডোনিয়ায় বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আমন্ত্রিত সম্মানিত বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা অবশ্যই গর্ভের। পরিশেষে মোহাম্মদ রিমন নবীন ফটোগ্রাফারদের উদ্দেশ্যে বলেন, এই পথে আসতে হলে সততা, একাগ্রতা ও অধ্যবসায় থাকতে হবে। ছবি তোলার কাজে পরিশ্রমি ও মনোযোগি হতে হবে। মনে রাখতে হবে পরিশ্রম ব্যতিত কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছা অসম্ভব। ক্যামেরাবন্দীর সকল কৌশল আয়ত্বে আনতে হবে। বিখ্যাত আলোকচিত্রীদের কর্ম নিয়ে লেখা বই পড়তে হবে। বিখ্যাত আলোকচিত্রীদের ছবি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে ও পরক করতে হবে।


 

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট