হজ নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা : ১১ ফ্লাইট বাতিল : নানা অনিয়ম

প্রকাশিত: ১:২৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০১৬

Manual2 Ad Code
মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব : প্রতিবছরের মতো এবারো পবিত্র হজ পালনে হজযাত্রীদের নিয়ে দুর্নীতির কারণে চরম বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে। হজ পালনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কোটা বাণিজ্য, ভিসা, সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া, খাওয়া, জিয়ারত, বিমান ভাড়াসহ প্রতিটি পদে পদেই অনিয়ম ও অবৈধভাবে সুবিধা নেয়ার অভিযোগ প্রতিবছরই হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয় হজ নিয়ে বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি করলেও দুর্নীতি ও ভোগান্তি মুক্ত হচ্ছে না পবিত্র হজ যাত্রা। মন্ত্রণালয় ও হজ অফিসের একেক সময় একেক সিন্ধান্তে এবারো ভূগান্তিতে পড়েছেন হজযাত্রীরা। হাবের অভিযোগ, ধর্ম মন্ত্রণালয়, হজ অফিস, হাব ও বিমানের মাঝে কোনো সমন্বয় নেই। এক অফিসের নির্দেশনা অন্য অফিস না মানায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে হজ যাত্রীরা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হজযাত্রায় ভোগান্তির শেষ নেই। মন্ত্রণালয় ও হজ এজেন্সির অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিতে গিয়েই বিশৃংখলায় ভোগান্তিতে পড়ছে হজযাত্রীরা। শেষ মুহূর্তে অতিরিক্ত কোটা, রিপ্লেসমেন্ট ও ভিসা জটিলতায় সৃষ্টি হয়েছে চরম বিশৃংখলা। হজ ফ্লাইটের শিডিউল করা অনেক হজযাত্রীর ভিসা হয়নি। যার ফলে নির্ধারিত ফ্লাইটে যেতে পারছে না হজযাত্রীরা। লাগেজ নিয়ে হজ ক্যাম্পে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছে তারা। তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। কেউ কান্নকাটি করছে, কেউ আবার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। আর এজেন্সি মালিকদের মধ্যেও বেড়েছে পেরেশানি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনের ভিসা হয়েছে অন্য জনের হয়নি এমন ঘটনাও ঘটেছে। যার ফলে নির্ধারিত ফ্লাইটের সিট খালি যাচ্ছে, পরবর্তী ফ্লাইটের যাত্রীদের এগিয়ে এনে ফ্লাইট শিডিউল অব্যাহত রাখা হচ্ছে। যাত্রী স্বল্পতায় ১২ দিনে ১০টি হজ ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় জটিলতায় পড়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এই পরিস্থিতিতে গতকাল বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হজ এজেন্টদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রীর আসন ও টিকেট নিশ্চিত করতে অনুরোধ করেছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে হজযাত্রীদের ভিসা জটিলতায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে হজ এজেন্সিগুলোর সমিতি- হাব এজন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়কে দায়ী করেছে। বিমানের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “বাতিলকৃত ফ্লাইটের কারণে বিমানের হজযাত্রী পরিবহনে ৫ হাজার আসনের ক্যাপাসিটি খোয়া গিয়েছে। গত ৪ আগস্ট শুরু হওয়া হজ ফ্লাইট পরিচালন কার্যক্রমের আওতায় এ পর্যন্ত বাতিলকৃত ফ্লাইটের কারণে আর্থিক ও মারাত্মক যাত্রী সংকটের মুখোমুখি হয়েছে বিমান।” : হাবের সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল্লাহ বলেন, “এবার ১ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ জনের ভিসা হওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত কেবল ৬৫ হাজার জনের ভিসা হয়েছে।” ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ ব্যবস্থানায় ‘চরম অব্যবস্থাপনার’ অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “যারা হজের ভিসা পেয়েছেন তাদের জন্য নিয়ম মেনেই বিমানের টিকেট বুকিং দিয়েছে হজ এজেন্টরা। ভিসা কম হওয়ায় বিমানের ফ্লাইটে কম লোক গেছে। যাত্রী স্বল্পতার কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এখন পর্যন্ত মোট ১০টি হজ ফ্লাইট বাতিল করেছে। বাতিলকৃত ফ্লাইটের কারণে বিমানের হজযাত্রী পরিবহনে ৫ হাজার আসনের ক্যাপাসিটি খোয়া গেছে। ভিসা জটিলতায় যাত্রী স্বল্পতায় আরো একটি ফ্লাইট বাতিলের পথে বলে তিনি জানান। : এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক খান মোশাররফ হোসেন বলেন, উপর্যুপরি ফ্লাইট বাতিল ও যাত্রী সংকটের বিষয়টি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ অবস্থা উত্তরণে বা পরিস্থিতির আরো অবনতি রোধে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সকল হজ এজেন্টকে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিমানে তাদের আসন নিশ্চিত-পূর্বক প্রযোজনীয় টিকিট সংগ্রহের অনুরোধ জানিয়েছে। : হজ এজেন্সি এসকে এয়ার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী কবির হোসেন  বলেন, কোটা পদ্ধতির জটিলতার ফাঁদে পড়েছে হাজার হাজার হজযাত্রী। কনফার্ম টিকিট থাকার পরও দেরিতে কোটা অবমুক্ত করায় অনেক হজযাত্রী এখনো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে পায়নি। বিষয়টিকে একটি অদূরদর্শিতার ফসল হিসেবেও আখ্যায়িত করেন কবির হোসেন। : হজযাত্রীর অনলাইন নিবন্ধন বিলম্বিত হওয়ায় তুলনামূলক কমসংখ্যক ভিসা ইস্যু হওয়া, এজেন্সিগুলোর মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া এখনো পুরোপুরি সম্পন্ন না হওয়া, এজেন্সিগুলোর নিজস্ব শিডিউল অনুযায়ী হজযাত্রী না পাঠানো বিমানের হজযাত্রী সঙ্কটের কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। আগামী কয়েক দিনেও এভাবে আরো ফাইট বাতিলের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শেষের দিকে হজযাত্রী পরিবহনে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। : বিমানের এমডি মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, আমরা হজযাত্রী পরিবহনের জন্য ক্যাপাসিটি তৈরি করেছি। সেই অনুযায়ী শ্লট নিয়েছি। আমাদের প্রস্তুতির মধ্যে কোনো ঘাটতি নেই। এখন প্রতিদিনই আমরা যাত্রী সঙ্কটের বিষয়টি হজ অফিস ও ধর্ম মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছি। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। শেষের দিকে এক হজযাত্রীদের চাপ বাড়লে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। : হাবের সভাপতি ইব্রাহিম বাহার অভিযোগ করেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হজ অফিেেসর সমন্ব^য়হীনতার কারণেই বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে। এক অফিসের কথা অন্য অফিস শুনছে না। হজযাত্রীদের যৌক্তিক দাবিগুলোও বিবেচনা করছেনা হজ অফিস। হজ অফিস তিন চারশ পাসর্পোট একসাথে আটকিয়ে ভিসার ছাড়পত্র দেয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে। : এদিকে হজ অফিসের পরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল হজ এজেন্সিগুলোকে তাদের হজযাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন জটিলতার কারণে আংশিক ভিসা হওয়া এবং কিছু সংখ্যকের এখনো ভিসা না হওয়ায় একত্রে পাঠাতে পারছে না এমনটি জানিয়েছেন। আবার অনেকে মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়ার তারিখের সাথে সমন্বয় করে পরে হজযাত্রীদের পাঠানোর অপেক্ষায় থাকায় এখনই হজযাত্রী পাঠাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। বেশ কিছু এজেন্সি বিলম্বে হজযাত্রী রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন জটিলতায় মক্কা-মদিনায় এখনো বাড়ি ভাড়ার কাগজপত্র তৈরি করে হাতে না পাওয়ায় বারকোর্ড নিয়ে দেশে ফিরে ভিসার জন্য আবেদন করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। : হাবের সভাপতি মো: ইব্রাহিম বাহারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে অন্যান্য বছরের চেয়ে এ পর্যন্ত ভিসা না হওয়ার কারণেই মূলত হজযাত্রী সঙ্কটে বিমানের ক্যাপাসিটি লস এমনকি ফ্লাইটও বাতিল করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা যতটুকু জেনেছি এ পর্যন্ত মাত্র ৫৬ হাজার হজযাত্রীর ভিসা হয়েছে। অন্যান্য বছর এ সময়ে ৮০ হাজারের মতো ভিসা হয়ে যেত। এতে ফাইটে কোনো সমস্যা হতো না। : জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিব আবদুল জলিল বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার ভিসা ইস্যু হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি আজ পর্যন্ত হজযাত্রী গেছেন ৩০ হাজারের মতো। ফলে ভিসা না হওয়ায় হজযাত্রী যেতে পারছেন নাÑ এ অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, হজ অফিসের পরিচালক এজেন্সিগুলোকে নিয়ে বসেছিলেন। তারা তাদের নিজস্ব কিছু সমস্যার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, তারা তাদের মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়ার শিডিউলের সাথে মিল রেখে হজযাত্রীদের নিয়ে থাকেন। এ জন্য তারা অপেক্ষায় আছেন। : এদিকে হজের জন্য অতিরিক্ত কোটা আদায়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় অনীহা দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করছে হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠন। তাদের মতে, বাংলাদেশ ২০ হাজার হজযাত্রীর অতিরিক্ত কোটার জন্য আবেদন করলে সেটা সহজেই পাওয়া সম্ভব। কারণ কয়েকটি দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এবার কয়েক লাখ হজযাত্রী কম হচ্ছে। যেসব দেশ অতিরিক্ত হজযাত্রীর আবেদন করছে তাদেরকে কোটা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয় এজেন্সিগুলোর দাবি সত্ত্বেও অতিরিক্ত কোটার জন্য নতুন কোনো অনুরোধ পাঠাচ্ছে না। এমন কি আগে যে ১০ হাজার কোটার জন্য অনুরোধ করেছিল তা আদায়েও তৎপরতা চালাচ্ছে না। সৌদি আরব নতুন করে আরো ১১ হাজার হজযাত্রীর কোটা দেয়ার আভাস দিলেও কাজের চাপের কারণে তা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ হাবের। : হাব সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক রুহুল আমিন মিন্টু সৌদি আরব থেকে ফোনে অভিযোগ করেন, প্রাক নিবন্ধন করেছেন এমন ৪০ হাজার হজযাত্রী এবার হজে যেতে পারছেন না। তারা কোটার অতিরিক্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমরা সৌদি আরবে মোয়াসসাসা অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি, আবেদন করলে ২০ হাজার অতিরিক্ত কোটা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দেশে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানানো সত্ত্বেও আমলে নেয়া হচ্ছে না। সময়স্বল্পতা এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে জটিলতার আশঙ্কার অজুহাত দেখিয়ে অতিরিক্ত কোটার ব্যাপারে অনীহা দেখানো হচ্ছে। : অতিরিক্ত কোটা আদায়ে অনীহার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিব আবদুল জলিল বলেন, আগে ১০ হাজারের জন্য যে অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে সেটাও তো পাওয়া যায়নি। নতুন করে আবেদন করে কী লাভ হবে। তিনি অনীহার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আগে অতিরিক্ত যে ১০ হাজারের জন্য ডিওলেটার পাঠানো হয়েছে তার রিমাইন্ডার দিয়ে ধর্মমন্ত্রী শনিবার সৌদি আরবে আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছেন। : উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে হজ পালনে এ বছর বাইতুল্লাহ জিয়ারাতে যাবার কথা ১ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ জন হজযাত্রীর। গত ৪ আগস্ট থেকে যৌথভাবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদি এয়ারলাইন্স হজযাত্রী পরিবহন শুরু করে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৬ আগস্ট পর্যন্ত মোট হজযাত্রী ৩৬ হাজার ৭৫২ জন সৌদি আরবে পৌঁছেছেন। আগতদের সরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রী ২ হাজার ৭০৫ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রী ৩৪ হাজার ৪৭ জন। এখন (১৭ আগস্ট, বুধবার) যাবত পরিচালিত হজ ফ্লাইট সংখ্যা ১১১টি। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পরিচালিত ৪৭টি এবং সৌদি এয়ারলাইন্স পরিচালিত ফ্লাইটের সংখ্যা ৬৪টি।

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code