আপেলই ছিল মুনতাহার জীবনের শেষ খাবার

প্রকাশিত: ১০:০৪ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১২, ২০২৪

আপেলই ছিল মুনতাহার জীবনের শেষ খাবার


বাবাকে খুঁজে না পেয়ে দুটি আপেল হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায় ৬ বছরের শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিন। দুটি আপেলের মধ্যে একটির আপেলের অর্ধেক খেতে পারলেও বাকি অংশটুকু আর খাওয়া হয়নি। সাবেক গৃহশিক্ষিকার ঘরের পাশে আপেলের সেই অংশটুকু পড়ে থাকলেও নেই শুধু মুনতাহা। কে জানতো এই আপেলই ছিল মুনতাহার জীবনের শেষ খাবার। আর ওই শিক্ষিকা হবেন তার হত্যাকারী। কিন্তু কেন নিষ্পাপ এই শিশুটিকে হত্যা করা হলো, কি ছিল তার অপরাধ এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে গ্রামবাসীর মনে।

নিখোঁজের ৭ দিন পর রোববার (১০ নভেম্বর) ভোর ৪টার দিকে বাড়ির পাশের খাল থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয় সিলেটের কানাইঘাটের নিখোঁজ শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে। সে উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে।

এ ঘটনায় গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মার্জিয়াসহ ৪ জনকে গ্রেফতারের পর শামীমার বসত ঘর পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। তখন সেই ঘরে মুনতাহার হাতে থাকা দুটি আপলের মধ্যে একটি আপেল অর্ধেক খাওয়া ও অন্যটা আস্ত পাওয়া যায়।
পরিবার ও গ্রামবাসীর তথ্যমতে, ৩ নভেম্বর সকালে নিখোঁজের আগে মুনতাহা আক্তার জেরিন তার বাবা শামীম আহমদের সঙ্গে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে বাড়িতে আসে। পরে চিপস খাওয়ার জন্য ৫ টাকা চাইলে তার বাবা চিপস এনে দেন। কিছুসময় পর যোহরের ওয়াক্ত হওয়ায় মসজিদে নামাজে চলে যান শামীম। তখন দুটি সবুজ রঙয়ের আপেল হাতে নিয়ে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মুনতাহা। এরপর থেকেই আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।


মুনতাহা নিখোঁজের পর দেশে-বিদেশে অসংখ্য মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার সন্ধান চেয়ে স্ট্যাটাস দেন। পরিবারের পক্ষ থেকে সন্ধানদাতাকে ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এছাড়া অনেকে শিশুটির সন্ধানদাতার জন্য বিভিন্ন রকমের পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। নিখোঁজের সাতদিন পর রোববার ভোররাতে ফুটফুটে সুন্দর মুনতাহাকে পাওয়া যায় কাঁদামাখা নিথর দেহে।
সোমবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে মুনতাহার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিস্তব্ধ চারপাশ। ঘটান্থলের পাশে দূরন্ত মুনতাহার ছুটে চলা ও তার স্মৃতিস্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন প্রতিবেশীরা। কিছু সময় পর পর ছুটে আসছেন গ্রামের শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষ। তারা বলছেন-এমন ফুটফুটে সুন্দর ছোট মুনতাহা কি এমন অপরাধ করেছিল। যার জন্য তাকে হত্যা করা হলো?
এসময় কথা হয় মুনতাহার প্রতিবেশী আব্দুল ওয়াহিদ ওরফে মটরের সঙ্গে। তিনি বলেন, মুনতাহা খুবই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। অনেক দুষ্টমি করতো। রোজ আমার বাড়িতে যেতে আমার আরেক নাতির সঙ্গে খেলাধুলা করতো। সে তাকে যে এইভাবে হত্যা করা হবে তা কল্পনা করতে পারিনি। ঘটনার ৭ দিনের মাথায় তা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আমার বাড়ির পুকুরে লাশ ফেলার পাঁয়তারা করেছিলো ঘাতকরা। আল্লাহর মেহেরবানিতে খুনি লাশসহ গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে। আমি এই ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চাই।
মুনতাহার বড় বোন জেবিন বলেন, মুনতাহাকে মার্জিয়া প্রাইভেট পড়াতো। পড়ানোর সুবাদে মুনতাহা ও মার্জিয়া তাদের বাড়িতে যাতায়াত করতো । অনেক সময় তাদের ঘর থেকে কাপড়চোপড় ও বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যেতো মার্জিয়া। বিষয়টি টের পেয়ে তাকে বলে দেয়া হয় প্রাইভেট পড়াতে না আসার জন্য।

তিনি বলেন, প্রথম থেকে মার্জিয়া ও তার মাকে সন্দেহ ছিল। আমাদের মনে হয়ছিল ঘরে এই হত্যাকাণ্ড করবে না। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল মুনতাহাকে দেখেছে কি না। তখন মার্জিয়া অস্বীকার করে মুনতাহাকে সারাদিনের মধ্যে দেখেনি। আমাদের মনে হয়েছে টাকার জন্য লোভে পড়ে তাকে লুকিয়ে রেখেছে। টাকা দিয়ে দিলে ফিরিয়ে দেবে। আর তার আগে কথা বললে যদি মুনতাহাকে মেরে মেরে ফেলে তাই চুপ ছিলাম আমরা। আমার নিষ্পাপ বোনকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ বলেন, আমার মেয়েকে এভাবে মেরে ফেলবে এইটা আমার চিন্তায় আসেনি। যে মেয়েটি মুনতাহাকে হত্যা করেছে সে কয়েকমাস তাকে প্রাইভেট পড়িয়েছিল। আমার মেয়েটা আপেল নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলো। সেটাও খেতে পারেনি।
তিনি বলেন, মুনতাহা মোবাইল চালাতে খুব দক্ষ ছিল। মোবাইল না দিলে তাকে ৫টাকা দিতে হয়। আমি আমার মেয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার দেশবাসীকে দিলাম। তারা যেটি ভাল মনে করবেন আমি সেটির ওপর বিশ্বাস রাখবো। তারা যে বিচার চাইবেন সেটি আমারও চাওয়া থাকবে। আমার মেয়েকে আমি জন্ম দিয়েছি ঠিক কিন্তু যেভাবে সারাদেশের মানুষ আমার মেয়ের জন্য কেঁদেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (কানাইঘাট সার্কেল) অলক শর্মা বলেন, গ্রেফতারকৃতদের আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা রাখি।


সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট