একজন কামরুল ও একটি আত্মহত্যা

প্রকাশিত: ৬:২১ অপরাহ্ণ, জুন ৬, ২০২৩

একজন কামরুল ও একটি আত্মহত্যা

‘তুমিও সুন্দর অইয়া চলিও, কামরুলে কুনতা কইলে আমরারে জানাইও।’ অনলাইনে যোগাযোগের অ্যাপ ‘হোয়াটসআপে’ ভাইবোনের কথোপকথনের স্ক্রিনশটের অংশ এটি। ছোট ভাইয়ের মোবাইলে বোনের নাম্বারটি ‘ছোটমনি’ নামে সেভ করা। ভাইটি তার ‘ছোটমনি’কে সবকিছু মানিয়ে নিয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। বোনের সংসারে তখন অশান্তি তাও ভাইটি বোনকে ‘সুন্দর হয়ে চলার’ পরামর্শ দিচ্ছেন-শুধু বোনের সংসারটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য। প্রত্যুত্তরে বোনও ভাইকে ‘মাথা গরম’ না করতে বলেন। এত মানিয়ে নেওয়ার পরও রেহাই মেলেনি শেফালির। শেষমেষ মৃত্যুকেই বেছে নেন তিনি। ৬ মে পরনের ওড়না গলায় পেঁচিয়ে ফাঁস নেন তিনি।

শেফালি বেগম সিলেটের দক্ষিণ সুরমার হবিনন্দী এলাকার মানিক মিয়ার মেয়ে। ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুনামপুর গ্রামের মজির উদ্দিনের ছেলে কামরুল হাসানের সাথে বিয়ে হয় তার। কামরুল ও শেফালি একে সম্পর্কে খালাতো ভাই বোন। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো। শেফালির পরিবারের ভাষ্য, পাত্র হিসেবে কামরুলকে পছন্দ না হলেও শেফালির পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে তারা দুজনের বিয়েতে রাজি হয়।

প্রথম কিছুদিন ভালোই যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে কামরুলের আসল রূপ সামনে আসতে থাকে। তুচ্ছ ঘটনায় তিনি শেফালিকে নির্যাতন করতে শুরু করেন। কামরুলের পরিবারেরও ইচ্ছে ছিলো না শেফালির সাথে কামরুলের বিয়ে হোক। তাই শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে শুরু থেকেই শেফালি ছিলেন অনাদরের। কামরুলকে তারা উসকে দিতে থাকেন শেফালির বিরুদ্ধে। পান থেকে চুন খসলেই কামরুল ও তার পরিবারের সদস্যরা চড়াও হতে থাকেন শেফালির উপর। এরমধ্যে দুবার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয় শেফালি বেগমের। সেজন্য শেফালিকেই দায়ী করেন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শেফালিকে ‘শায়েস্তা’ করার জন্য একটি বেতও রাখতেন কামরুল তার ঘরে। বেত রাখার বিষয়টির উল্লেখ পাওয়া যায় শেফালির সাথে তার ভাইয়ের কথোপকথনের স্ক্রিনশটে।

নিজের পছন্দে বিয়ে। পছন্দের মানুষের এমন রূপ কী করে পরিবারের সামনে তুলে ধরবেন শেফালি বেগম। তাই নীরবে সহ্য করতে থাকেন সকল নির্যাতন। কিন্তু বছরখানেক পর যখন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকের নির্যাতনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় শেফালিকে তখনই তার পরিবার জানতে পারে নির্যাতনের বিষয়টি। পরে সালিশ বৈঠকে কামরুল আর এমনটি করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেফালিকে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। কিন্তু এরপরও শেফালির উপর নির্যাতন থেমে থাকেনি। নির্যাতনের কারণে অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন শেফালি বেগম। পারিবারিকভাবে বারবারই বিষয়টির সমাধানের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

এমন অবস্থায় শেফালিকে তার বাবার বাড়ি রেখে যান কামরুল। এরপর আর যোগাযোগ করেননি।

মাস দুয়েক পর শেফালির স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার হোয়াটসআপ নাম্বারে ফোন দিতে শুরু করেন।

ফোনে জানানো হয়, শেফালিকে তালাক দিয়ে কামরুল আবার বিয়ে করবেন; ফোনে হুমকিও দেওয়া হয় শেফালিকে। এ ঘটনায় ভেঙে পড়েন শেফালি। একদম চুপচাপ হয়ে যান।

এরই মাঝে একদিন এসে কৌশলে শেফালির মোবাইল থেকে সব ধরনের মেসেজ মুছে দেন কামরুল। নিজের ভেতরে যন্ত্রণা যেনো সইতে পারছিলেন না শেফালি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই একদিন পাশে অবস্থিত মামার ঘরে বেড়াতে গিয়ে সবার অগোচরে গলায় ফাঁস নেন শেফালি বেগম।

শেফালি বেগমের পরিবারের ভাষ্য, কামরুল ও তার পরিবারের লোকজনই শেফালিকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এ অভিযোগে শেফালি বেগমের বড়ভাই পারভেজ আহমদ মোগলাবাজার থানায় একটি মামলাও (নং : ৯) দায়ের করেন।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয় কামরুল হাসানকে (৩৫)। এছাড়া কামরুলের মা রুসনা বেগম (৬০) ও ছোট দুই বোন সুমি বেগম (৩০) এবং রুমি বেগমকেও (২৫) আসামি করা হয় মামলা। তিনি এ মামলাটি করেন ৮ মে। এ মামলায় কেউই গ্রেপ্তার হননি।

এরই মাঝে পাল্টা একটি মামলা করেন কামরুলের মা রুসনা বেগম। সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানায় ২০ মে দায়ের হওয়া ওই মামলায় (নং : ২৬) তিনি ঘর পুড়ানোর অভিযোগ আনেন শেফালি বেগমের দুই ভাই পারভেজ আহমদ (৪৫) ও সাহেদ আহমদসহ (৪০) ৮/৯ জনের বিরুদ্ধে।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, দুইবার গর্ভের সন্তান নষ্ট হওয়ায় তার পূত্রবধু শেফালি বেগম মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পড়ে চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলে শেফালি বেগমকে তার মা বাড়িতে নিয়ে যান। কয়েকদিন পর জানতে পারেন তার পুত্রবধু মারা গেছেন।

এরপর থেকে তার ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। এরপর পারভেজ আহমদ ১২ মে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ লোকজন নিয়ে হামলা চালান ও বসতঘরের পাশে খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেন।

তবে এরই মাঝে যে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে তিনি ও তার পুত্র-কন্যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সেটা চেপে যান রোসনা বেগম। তার পুত্রবধু শেফালি বেগম যে আত্মহত্যা করেছেন সেটাও তিনি মামলার অভিযোগে উল্লেখ করেননি। পারভেজ আহমদের দাবি তাদেরকে চাপে রাখতেই এ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন তার বোনের শাশুড়ি রোসনা বেগম।

এ ব্যাপারে কথা হয় গোলাপগঞ্জ থানার সাব ইন্সপেক্টর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পার্থ সারথি দাসের সাথে। তিনি বললেন, আসলে এ মামলার ঘটনার সাথে অন্য একটি মামলার সম্পর্ক আছে বিষয়টি প্রথমে জানতে পারিনি। এ মামলার বাদির বিরুদ্ধে আসামিরা যে আগে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে একটি মামলা করেছিলেন তদন্তে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারি। তিনি বলেন মামলাটি এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এখনও তদন্ত চলছে। তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে বলে আশাবাদী তিনি।

তথ্য সূত্র দৈনিক একাত্তরের কথা, লিংক সংযুক্ত

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট