আখেরী চাহার সোম্বা কী ও কেন? এ বিষয়ে জ্ঞানগর্ব আলোচনা

প্রকাশিত: ৮:১১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২

আখেরী চাহার সোম্বা কী ও কেন? এ বিষয়ে জ্ঞানগর্ব আলোচনা

আখেরী চাহার সোম্বা একটি যুগল শব্দ। এটি আরবি ও ফার্সী শব্দ দ্বারা গঠিত হয়েছে। আরবি শব্দ হলো “আখেরী” আর ফার্সী শব্দ হলো “চার শম্বাহ”। যেহেতু এক সময়ে ফার্সী ভাষা প্রচলিত ছিল আর ফার্সী ভাষায় বুধবারকে চার শম্বাহ বলা হয়। সফর মাস আরবী হিজরী মাসের দ্বিতীয় মাস। আর মাহে সফরের শেষ বুধবারকে ইসলামী পরিভাষায় মুসলিম সমাজে আখেরী চাহার সোম্বা হিসেবে বুঝায়। মুসলিম সমাজে সফর মাসের শেষ বুধবারকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়।


প্রেক্ষাপট : দুনিয়াবী সকল বাতিল অপশক্তি প্রয়োগ করে ব্যর্থ হয়ে ইহুদীগণ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যাদু করেছিল। কিন্তু তাদের যাদু শক্তি প্রিয় নবীর মধ্যে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অবশেষে ৭ম হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মুহাররম মাসে মদিনায় ইহুদী নেতৃবৃন্দ লবীদ ইবনে আসম ইয়াহুদীকে বলল, তুমি ও তোমার কন্যাগণ তো যাদু বিদ্যায় পারদর্শী। সুতরাং মুসলমানের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধ্বংস ও ক্ষতি সাধনের জন্য যাদু করো। লবীদ কৌশলে প্রিয় রাসূলের এক ইহুদী গোলামের মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ব্যবহৃত চিরুনীর ভাঙ্গা দাঁত ও চুল মোবারক সংগ্রহ করে নিলো। তারপর মোমের একটা পুতুল তৈরি করে তাতে এগারোটি সুঁচ ঢুকিয়ে দিল। একটি সুতায় ১১টি গিরা দিলো। এসব কিছু ওই পুতুলের ভেতর স্থাপন করে প্রবহমান কূপের পানির ভিতর একটা পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রেখে দিলো। এর প্রভাবের ফলে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ চল্লিশ রাত বা ছয় মাস অথবা এক বছরকাল শারীরিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন।

অত:পর হযরত জিব্রাইল আমীন আলাইহিস সালাম সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস এ দুটি সূরা প্রিয় নবীর উপর নাজিল/অবতীর্ণ করলেন। আর এ দু’টি সূরা মিলে আয়াত সংখ্যা হয় ১১টি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওহীর মাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ দেয়া হল। অত:পর আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে উক্ত কূপে পাঠিয়ে ছিলেন, তিনি কূপের পানি ফেলে দিয়ে যাদুর সব সামগ্রী পাথরের নীচ থেকে বের করে নিয়ে আসলেন। তখন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সূরা ২টি পাঠ করলেন প্রতিটি আয়াত পাঠের সদকায় একেকটি করে গিরা খুলে গেল। ফলে আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরোগ্য লাভ করলেন এবং গোসল করলেন। ওলামায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন সে দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার।

তাই বালা-মুসিবত, রোগ-শোক থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে মুসলিম সমাজ এ দিবসটি গোসল, দোয়া, মিলাদ-মাহফিল, জিকির-আজকার, দরূদের মাধ্যমে ভাল ও উত্তমপন্থা হিসেবে পালন করে থাকে। ওয়াজিব ও জরুরি হিসেবে নয়। ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রা:) “জাওয়াহেরুল কুনুজ” কিতাবের ৫ম খন্ডের ৬১৬ পৃষ্ঠার বরাতে স্বীয় রচিত “ফতোয়ায়ে আজিজীতে উল্লেখ করেন সফর মাসের শেষ বুধবার সূর্যোদয়ের পূর্বে গোসল করা উত্তম। আর সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা ভাল ও সাওয়াবের কাজ।

উক্ত কিতাবের ৬১৭ পৃষ্ঠায় আরও উল্লেখ রয়েছে- মাহে সফরের শেষ বুধবার সাতটি আয়াতে সালাম লিখে তা পানিতে ধুয়ে পানিটুকু পান করা উত্তম ও শেফা। “তাজকিরাতুল আওরাদ” কিতাবে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি আখেরী চাহার সোম্বা তথা মাহে সফরের শেষ বুধবারে প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজের পর আয়াতে রহমত (সাত সালাম বিশিষ্ট আয়াতে করিমা) পাঠ করে নিজের শরীরে ফুঁক দেবে বা তা পানের উপর লিখে ধুয়ে পানি পান করবে আল্লাহ পাক তাকে সব রকম বালা-মুসিবত ও রোগ-ব্যাধি হতে নিরাপদে রাখবেন।

ফতোয়ার কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, যে ব্যক্তি আখেরী চাহার সোম্বার দিন দু’রাকাত নফল নামায আদায় করবে আল্লাহ তাকে হৃদয়ের প্রশান্তি দান করবেন। মাহে সফরের শেষ বুধবার নফল নামায, দোয়া-দরূদ পড়া, কলা পাতায়/কাগজে আয়াতে শেফাসমূহ লিখে গোসল করা এবং আয়াতে সালামসমূহ লিখে পানিতে দিয়ে তা পান করা ভাল ও উত্তম আমল। এতে শরীয়তের দৃষ্টিতে বাধা নেই।

তদুপরি “আর রাহিকুল মাখতুম” আরবী সীরাত গ্রন্থে সফিউর রহমান মোবারকপুরী বর্ণনা করেন- অর্থাৎ হুজুর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল শরীফের পাঁচদিন পূর্বে (প্রিয় নবীর দুনিয়াবী হায়াতের শেষ বুধবারে (চাহার সোম্বা দিবসে) প্রিয় নবীর নূরানী শরীর মোবারকের উত্তাপ অত্যন্ত বেড়ে গেল। এতে তাঁর কষ্ট বেশি হয়ে গেল। বেঁহুশের মত হয়ে গেলেন। এ সময় তিনি বললেন, তোমরা বিভিন্ন কূপের সাত মশক পানি আমার উপর ঢাল, যাতে আমি সাহাবায়ে কেরামের নিকট যেতে পারি এবং প্রতিশ্রুতি নিতে পারি। অত:পর উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে (প্রিয় রাসূলকে) বসালেন এবং তাঁরা তাঁর শরীর মোবারকে পানি প্রবাহিত করলেন। তিনি বলতে লাগলেন, যথেষ্ট, যথেষ্ট। তিনি সুস্থতা বোধ করলেন এবং মসজিদে নববী শরীফে মাথা মোবারকে পট্টি বাঁধাবস্থায় তাশরীফ নিলেন, তারপর মিম্বর শরীফে বসে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের সম্মুখে বক্তব্য পেশ করলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম তাঁর চতুর্পার্শে সমবেত ছিলেন। (আনওয়ারুল আউলিয়া, ফতোয়ায়ে আজিজী, আর রাহিকুল মাখতুম, পৃ: ৪৬৫)

উপরিউক্ত বর্ণনা মতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ারী হায়াতের শেষ বুধবার সাত মশক পানি দ্বারা গোসল করেছেন এবং সুস্থতা অনুভব করে মসজিদে নববী শরীফে প্রবেশ করেছেন এবং খুতবা (বয়ান) প্রদান করেছেন। যাদের এ বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে, আপনারা জাওয়াহেরুল কুনজ, ফতোয়ায়ে আজিজী এর বর্ণনাসমূহ দেখার ও অনুধাবন করার আহবান রইল। (ফতোয়ায়ে আজিজী, কৃত: ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী শেরে বাংলা আজিজুল হক আল্-ক্বাদেরী র.)


ইসলামী গবেষণা বিভাগ
বাগদাদী ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা- ৩৫০০, বাংলাদেশ।


 

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট