কেকের গায়ে স্বপ্ন আঁকেন মুনিরা

প্রকাশিত: ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১

কেকের গায়ে স্বপ্ন আঁকেন মুনিরা

 


নীশিতা মিতু : বর্তমানে হোম বেকার হিসেবে অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেক নারীই। মুনিরাও তাদেরই একজন। কেক, মিষ্টি খাবার কখনো কখনো পিৎজা তৈরি করেন তিনি। তবে অন্যদের চেয়ে মুনিরার কাজ বেশ ভিন্ন। কেকের মাধ্যমে যেন না বলা গল্প সাজান তিনি, তৈরি করেন স্বপ্নের প্রেক্ষাপট। কেক তার জন্য জীবন্ত ক্যানভাস। কখনো যে ক্যানভাসের গায়ে ফুটে ওঠে প্রিয় বইয়ের প্রচ্ছদ, কখনো দেখা যায় প্রিয় ফুল আবার কখনোবা কোনো বিশেষ স্মৃতি।

স্বাদ আর সৌন্দর্যের এক চমৎকার সমন্বয় মুনিরার বানানো কেকগুলো। এই শিল্পী বেকারের সঙ্গে আড্ডা হয় দৈনিক অধিকারের। জানা হয় নানা কেকের সম্পর্কে, শোনা হয় ব্যক্তিগত কিছু কথাও-

সিরাজুম মুনিরা। জন্ম ১৯৮০ সালের ১১ই নভেম্বর কুমিল্লা জেলাতে। একমাত্র সন্তান হওয়ায় বেশ একাকীত্বে কাটে ছেলেবেলা। শৈশবের স্মৃতিও মনে নেই তেমন একটা। পেশায় একজন অনলাইন বেকার তিনি। বেকিং এর প্রতি সন্তানদের ভালোলাগা থেকে একসময় নিজেরও পছন্দের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে এটি। একসময় পরিবারের বাইরে অন্যদের জন্যও কাজ করা শুরু করেন। প্রিয় কাজের ক্ষেত্রই হয়ে ওঠে উপার্জনের মাধ্যম।

মুনিরার অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মৌপানি কেকারি’। মৌমিতা, পারমিতা ও নিহাল। তিন সন্তানের নামের অদ্যাক্ষর থেকেই “মৌপানি” শব্দটি এসেছে। মুনিরার স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে।

কী কী পণ্য নিয়ে কাজ করেন? জানতে চাই মুনিরার কাছে। তিনি বলেন, আমি কাস্টমাইজড কেক নিয়েই কাজ করি। মানুষের কল্পনার নানা স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন কেকের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। কাস্টমাইজড প্রতিটি কেকের আলাদা আলাদা গল্প থাকে,ভালো লাগা, অতীত স্মৃতি, ভালোবাসা প্রকাশ করা, বাচ্চাদের শৈশব, কৈশোর সবকিছুতে নিজেকে রেখে একেকটি কেকের দৃশ্যপট তৈরি করি।

এছাড়াও বিভিন্ন ডেজার্ট নিয়েও কাজ করি। আমার মডিফাইড করা একটি ডেজার্ট “গ্লীজবি” সবাই খুবই পছন্দ করে আলহামদুলিল্লাহ্। গুড়ো দুধ, ডিম, চিনি, ক্যারামেল বাটারক্রিমের দারুন কম্বিনেশন এই ডেজার্টটি। এটি এত বেশি প্রশংসিত হয় যে পরবর্তীতে এটির অনলাইন ক্লাস নেই এবং এখন দেশ বিদেশে অনেক বেকাররাই এটি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করে প্রশংসিত ও সমাদৃত হচ্ছেন।

কেকের গায়ে স্বপ্ন আঁকেন মুনিরা

মুনিরার তৈরি কটন চিজ কেক, গ্লীজবি

আর একটি বিশেষ কেক “জাপানিজ কটন চিজ কেক”। এটিও আমার পেইজের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া কেক আইটেম। হালকা মিষ্টি, তুলোর মতন নরম, ক্রিম চিজের মিষ্টি ফ্লেভারযুক্ত এই কেকটি সবাই একবাক্যে পছন্দ করে। এছাড়াও আলমন্ড ফ্লাওয়ারের কুকি ম্যাকারন করি যেটা বাচ্চাদের খুবই ভালোলাগার একটি কুকি।

কেক নিয়ে তো কতজনই কাজ করে, মৌপানি কেন তাদের চেয়ে ভিন্ন? মুনিরা বলেন, আমি মন থেকে কাজ করি পেইজের জন্য। প্রতিটি কাস্টমাইজড কেক বা ডেজার্ট বানানোর সময় নিজের সন্তানদের কথা মাথায় রাখি, যেই উপাদান দিয়ে কেক বানালে আমার বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হবে না এবং তারা কেক বা ডেজার্টটি উপভোগ করে খেতে পারবে ঠিক সেভাবেই পেইজের অর্ডারের কাজগুলো করি।

খাবারের মান আর স্বাদকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমার প্রতিটি আইটেমের খরচ অনেক বেড়ে যায় কিন্তু সে সত্ত্বেও আমি মানের সঙ্গে কোনো আপোষ করিনি কখনো। আর এজন্যই আমার রিপিট ক্লায়েন্ট সবচেয়ে বেশি। কোনোদিন চুলচেরা হিসাব করে কেক বানাইনি, ক্লায়েন্ট যে ওজন চান কেকের তার চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি দিয়েছি সবসময় তবে কম দেইনি। আমি সবসময় ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করার চেষ্টায় থাকি আর এই কারণেই ক্রেতা আকৃষ্ট হয় আমার কেকের প্রতি।

করোনাকালীন সময়ে বেড়েছে বাসায় তৈরি খাদ্যের চাহিদা বেড়েছে। ক্রেতারা বাজারের কেকের চাইতে ঘরে তৈরি কেকের দিকে ঝুঁকছেন বেশি। এর সুযোগ নিচ্ছেন কিছু হোমবেকার। এমনটাই মনে করেন মুনিরা। তিনি বলেন, বর্তমানে কিছু হোমবেকার ভেজাল উপাদান দিয়ে কমদামি সস্তা কেক বানিয়ে ক্রেতাসাধারণের নজর কাড়ার চেষ্টায় আছেন। ফলে খারাপের দায়ভার সবার ঘাড়েই এসে পড়ে। তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো, এখন ক্রেতারাও ভালো-মন্দ বুঝতে শিখছেন।

ক্রেতাদের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক মুনিরার। তিনি বলেন, ক্রেতারা আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেন, ভরসা করেন আর বিশেষ দিন বা ক্ষণ স্মরণীয় করে রাখার গুরুদায়িত্ব দেন আমার ওপর। আমিও সেই ভরসা রাখার চেষ্টা করি আপ্রাণ। আমার ক্রেতারাই পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় আমার পেইজ মেনশন করে থাকেন। আর তাই ক্রেতাদের কাছে আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ।

হঠাৎ চুপ হয়ে যান মুনিরা। মন খারাপ করেই বলেন, প্রায়ই ভাবি ব্যবসা ছেড়ে দিব। চল্লিশোর্ধ শরীরে নানারকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা মাঝে মাঝে বেশ কষ্ট দেয়। এক হাতে সংসার, সন্তান আর ব্যবসা সামলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি। কয়েক রাতের নির্ঘুম ক্লান্ত শরীর। মন বলে ওঠে আর না! কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হয় এভাবে ছেড়ে আসা যায় না। মনে মনে একটি অঙ্গীকার নিয়েই এ কাজে এসেছি। আর তা হলো, ‘ভেজালের ভিড়ে খাটি মানের নিশ্চয়তা’। তাই যতদিন পারি সে চেষ্টাই করে যেতে হবে। তাছাড়া যখন কেউ অনুরোধ করে বলেন সন্তান/ মা-বাবা/ প্রিয়জনের একটা কেক চাই তখন নড়ে চড়ে ওঠে কাজ শুরু করি।

নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে মুনিরা বলেন, উদ্যোক্তা হতে হলে আগে উদ্যোগ এর দৃঢ়তা আনতে হবে, বিবেককে জাগ্রত রাখতে হবে এবং নিজ স্বার্থ অপেক্ষা ক্রেতার স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে -আর তখনই একজন নতুন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারুপে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

মৌপানি কেকারি নিয়ে অনেকদূর যেতে চান মুনিরা। ভালো মানের, ভালো স্বাদের কেক বানিয়ে যেতে চান ক্রেতাদের জন্য। বুকের মধ্যে ছোট্ট একটি স্বপ্নও লালন করেন। আর হলো একদিন নিজের একটা বেকিং স্টুডিও হবে। যেখানে থাকবে কেবল বেকিং এর সবকিছু। নিজের এই ছোট্ট স্বপ্ন যেন খুব তাড়াতাড়ি ছুঁতে পারেন মুনিরা সেই কামনাতে আড্ডার ইতি টানলাম।


মৌপানির ফেসবুক পেজের লিঙ্ক : Moupanee Cakery


 

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট