মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ নিয়ে গঠিত সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর সময় যতই গড়িয়ে রাজনীতিতে তিনি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মানুষের প্রয়োজনে পাশে থেকেছেন, দুর্যোগে সাহস দিয়েছেন, সংকটে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেজন্য দীর্ঘ ৮ বছরের প্রবাস জীবনের নানা প্রেক্ষাপট ছাপিয়ে তিনি উঠে উঠেছিলেন জননেতা সামাদ চৌধুরী।
রাজনৈতিক জীবনে নানা উত্থান-পতনের সাক্ষি এ রাজনীতিবিদ ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়ে পরাজিত হন। ১৯৯৬ এ জাতীয় পার্টির আব্দুল মুকিত চৌধুরী আর ২০০১ সালে বিএনপির শফি আহমেদ চৌধুরীর কাছে হেরে যান তিনি।
তবে পরপর দুই সংসদ নির্বাচনে হেরে গেলেও দমে যাননি ১৯৫৫ সালের ৩ জানুয়ারি জন্ম নেয়া এ রাজনীতিবিদ। বরং উৎসাহে-উদ্দীপনায় মানুষের কাছে ছিলেন। ছিলেন মানুষের সুখ-দুঃখের সময়ও। সেজন্য ২০০৮ সালের নির্বাচনে দীর্ঘ তিন দশকের ‘জাতীয় পার্টি-বিএনপির’ একক আধিপত্যের আসনটিতে নৌকা নিয়ে জয়ী হন মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী ৯৭ হাজার ৫৯৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শফি আহমদ চৌধুরী ৫৪ হাজার ৯৫৫ ভোট পেয়েছিলেন। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে মাহমুদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
আর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গড়ে ইতিহাস। এই নির্বাচনে ৯৩ হাজার ২৯৯ ভোটের ব্যবধানে বিএনপির শফি আহমদ চৌধুরীকে হারিয়ে হ্যাটট্রিক জয় পান মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী।
তবে হ্যাটট্রিক জয় কিংবা দীর্ঘদিন এমপি পদে থাকলেও কখনও অহংকার থাকে ছুতে পারেনি। বরং দিন যত গড়িয়ে ততই বিনয়ী হয়েছেন এ সাংসদ। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকা এলাকাটিতে উন্নয়নের জোয়ার তুলেছিলেন। বদলে দিয়েছেন মানুষের জীবনমান। সড়ক, কালভার্ট কিংবা সেতু যখনই মানুষের প্রয়োজন তখনই তা করতে এগিয়ে এসেছেন তিনি। এছাড়া মসজিদ-মন্দির, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে তার পদচারণা ছিলো সবসময়। কাজ করতে পছন্দ করতেন শিশুদের নিয়েও। ছিলেন শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর মেলার মহাসচিবও।
এদিকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে নিজের বাড়িতেই আয়োজন করেছিলেন সচেতনতামূলক কর্মশালার। সেই মানুষই করোনার কাছে হার মেনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। অভিজ্ঞ এ রাজনীতিবিদ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) দুপুর ২টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
অথচ করোনাভাইরাসের সংকটময় সময়ে তিনি সবসময় তাঁর নির্বাচনী এলাকার মানুষের পাশে ছিলেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই নিজ এলাকায় তৈরি করেছিলেন আইসোলেশন সেন্টার। লকডাউন চলাকালে হতদরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতে তিনি নির্বাচনি উপজেলার ২১টি ইউনিয়নে নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রতিনিধি। তাদের কাজ ছিল হতদরিদ্র মানুষের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া। লকডাউন চলাকালে বেকার হয়ে পড়া প্রবাসীদের পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
করোনাকালীন সময়ে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীকে অনেক প্রবাসী ফোন দিয়ে বলতেন হাতে টাকা না থাকায় পরিবারের মানুষ অনেক কষ্ট আছেন। তাদের কথা শোনে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী ২১টি ইউনিয়নে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছিলেন। এর বাইরে এলাকার দোকানগুলোয় বলে রেখেছিলেন, যেন তাঁর কাছে চাহিদা জানানো মানুষের কাছে খাদ্য ও নিত্যপণ্য দেওয়া হয়। সেই অর্থের জোগান দিতেন তিনি নিজেই। করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপে ২০২০ সালের মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে তিন হাজারের বেশি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছিলেন তিনি।
এছাড়া মাছ-সবজিসহ নানা খাদ্যসামগ্রী তার বাড়ির সামনের সিঁড়িতে থরে থরে সাজানো থাকত। সকাল ও বিকাল এসব খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হতো এলাকার মানুষের মাঝে। তার এ সহায়তা থেকে বাদ যায়নি চা শ্রমিকরাও। আর এসব কিছুই করতেন নিজের তহবিলের টাকা দিয়ে।
অন্য আরেকটি কারণে অনন্য এ রাজনীতিবিদ। যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করেছিলেন তিনি। এই বিল গৃহীত হওয়ার পর বাংলাদেশে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া। পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধির দাবিও তিনি সংসদে তুলেছিলেন। ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কর্তৃক উত্থাপিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব ‘সংসদের অভিমত এই যে দেশের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হউক’ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। জাতীয় সংসদে গৃহীত ওই প্রস্তাবের পর শুরু হয় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া ও ট্রাইব্যুনাল গঠন।
প্রসঙ্গত, সাংসদ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তাঁর জানাজার নামাজ শুক্রবার বিকাল ৫টায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও মাঠে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়। পরে তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।