বাংলাদেশ মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে : পোপ ফ্রান্সিস

প্রকাশিত: ১১:৩৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৩০, ২০১৭

বাংলাদেশ মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে : পোপ ফ্রান্সিস

‘গত কয়েক মাসে রাখাইন থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ উদার মন এবং অসাধারণ সংহতির পরিচয় দিয়েছে।’ বলে মন্তব্য করেছেন ১২০ কোটি ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের নেতা পোপ ফ্রান্সিস।

বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে তার সৌজন্যে দেওয়া সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন। এসময় রাষ্ট্রপতির সাথে একান্ত বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বিকাল ৩টায় ঢাকায় পৌঁছে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনের পর বঙ্গভবনে যান পোপ।

পোপ ফ্রান্সিস বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসা অসহায় মানুষদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এই শরণার্থী সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস।

তিনি আরো বলেন ‘এটা ছোট কোনো বিষয় নয়, বরং পুরো বিশ্বের সামনেই এটি ঘটেছে। পুরো পরিস্থিতি, মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা আমাদের ভাই-বোন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু, তাদের ঝুঁকির গুরুত্ব বুঝতে আমরা কেউই ব্যর্থ হইনি।’

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের প্রশংসা করেন পোপ। তবে বিভক্তি তৈরি করতে কখনও কখনও ধর্মকে ব্যবহার করা হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে পোপের বক্তব্য এ সমস্যা সমাধানে সবাইকে আশান্বিত করেছে।

রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, কঠিন এই সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ। শুধু রাজনৈতিক বিষয়ের সমাধানই নয়, বাংলাদেশে দ্রুত মানবিক সহায়তাও দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ বিশেষ করে শরণার্থী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে পোপের জোরালো অবস্থানের কথা তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও পোপের এযাবৎকালের বক্তব্য বিশ্বনেতাদের আরো তৎপর করে তুলবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এরপর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পোপ ফ্রান্সিসের সাথে রাষ্ট্রপতি একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এব্যাপরে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান, বৈঠকে রাষ্ট্রপতি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সেক্ষেত্রে পোপের সক্রিয় সহায়তা কামনা করেন।

রোহিঙ্গার সংকট প্রশ্নে পোপের অবস্থানের প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেন যে, রোহিঙ্গাদের তাদের পিতৃভূমিতে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতকরণে পোপ ফ্রান্সিস খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভ্যাটিকান সিটির আন্তরিক সমর্থনের কথা স্মরণ করে বলেন, ১৯৭৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে ভ্যাটিকান সিটির দূতাবাস খোলার পর থেকে বাংলাদেশ ও ভ্যাটিকান সিটির সম্পর্ক ধীরে ধীরে জোরদার হয়েছে।

উল্লেখ্য পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বিকেলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। ক্যাথলিক ধর্মীয় গুরু ও সার্বভৌম ভ্যাটিকান সিটির প্রধান তার তিনদিনের মায়ানমার সফর শেষে বাংলাদেশ বিমানের একটি ভিভিআইপি বিমান বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মেঘদূত ফ্লাইটে বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে ঢাকায় অবতরণ করলে লাল গালিচা সংবর্ধনা পাশাপাশি ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয় এবং এসময় অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং দুটি শিশু ফুল দিয়ে বরণ করে নেন ৮৮ বছর বয়সী খ্রিস্টান ধর্মগুরুকে।

কিছুটা দূরে একদল শিশু তখন রবি ঠাকুরের আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে গানের সঙ্গে ঝালর নাড়িয়ে নৃত্য পরিবেশন করছিল। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতারা।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পোপ ফ্রান্সিসকে নিয়ে মঞ্চে আসার পর ভ্যাটিকান ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। তিন বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল তাকে গার্ড অব অনার দেয়। পরে পোপ গার্ড পরিদর্শন করেন। গার্ড পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সবার সঙ্গে পরিচিত হন পোপ। গাড়িতে ওঠার আগে শিশুদের পরিবেশিত নাচও তিনি দেখেন।

এসময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল আবু এসরার।

আরো উল্লেখ্য দুই পরিচয়ে পোপের এবারের এই সফর প্রথমত, ৩১৯ একর আয়তনের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে, দ্বিতীয়ত রোমান ক্যাথলিক গির্জার মহামহিম ও সর্বজনীন যাজক হিসেবেও পোপ ফ্রান্সিস এই সফরে এসেছেন।

১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় পোপ জন পলের সফরের সময় আর্মি স্টেডিয়ামে প্রায় ৫০ হাজার ক্যাথলিক খ্রিষ্টানের সমাগম ঘটেছিল। এবারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে ৮০ হাজার ক্যাথলিকের উপস্থিতির পরিকল্পনা করা হয়েছে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়সহ সব মানুষের কাছে তার এই আগমন জনগণের আত্মার প্রতি একধরনের তীর্থযাত্রা বলেও গণ্য হবে।

২০১৩ সালের ১৩ মার্চ ভ্যাটিকানের ২৬৬তম পোপ নির্বাচিত হন ফ্রান্সিস। রোমের বিশপ হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক চার্চ এবং সার্বভৌম ভ্যাটিকান সিটির প্রধান।

পোপ ফ্রান্সিসের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে। ক্যাথলিক পুরোহিত হিসেবে তার অভিষেক হয় ১৯৬৯ সালে। পুরো আমেরিকা অঞ্চল এবং দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ তিনি।

বাংলাদেশ সফরে আসা তিনি তৃতীয় পোপ। সর্বশেষ পোপ জন পল এসেছিলেন ৩০ বছর আগে ১৯৮৬ সালে।

পরবর্তী কর্মসূচী
সফরের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশে প্রার্থনা করবেন পোপ ফ্রান্সিস। এরপর ভ্যাটিকান দূতাবাসে সাক্ষাৎ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

বিকালে তিনি যাবেন কাকরাইলের রমনা ক্যাথেড্রালে, সেখানে আর্চবিশপ হাউজে বিশপদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। শান্তি কামনায় আন্তঃধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত ঐক্য বিষয়ক সভায় অংশ নেবেন।

সফরের শেষ দিন শনিবার সকালে তেজগাঁওয়ে মাদার টেরিজা হাউজ পরিদর্শনে যাবেন পোপ। এরপর তেজগাঁও হলি রোজারিও চার্চে খ্রিস্টান যাজক, ধর্মগুরু ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে চার্চের কবরস্থান পরিদর্শন করবেন। দুপুরের পর ঢাকায় নটরডেম কলেজে তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি।

সফরের ইতি টেনে বিকাল ৫টায় শাহজালাল বিমানবন্দর ছাড়বেন ক্যাথলিক ধর্মগুরু। তাকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।