দিল্লির বার্তায় পাল্টে যাচ্ছে কী ঢাকার রাজনীতির দৃশ্যপট?

প্রকাশিত: ২:৫১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩১, ২০১৭

দিল্লির বার্তায় পাল্টে যাচ্ছে কী ঢাকার রাজনীতির দৃশ্যপট?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গ টানেন। সবার মাঝে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একতরফা সে নির্বাচনে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়েও বাংলাদেশের ভেতরে সমালোচনা রয়েছে।

আওয়ামী লীগ বিরোধীরা মনে করেন, গত আট বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপকভাবে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। এবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যখন দু’দিনের সফরে ঢাকা আসলেন, তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে এনিয়েও নানা আলোচনা।

এ সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক ছাড়াও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি’র একটি প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করেছেন। সে বৈঠক শেষে বিএনপি’র তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে ভারত বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন দেখতে চায়।

দিল্লির এমন বার্তায় গত কয়েকদিনে দেশের রাজনীতিতে কিছুটা পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গেছে। ফলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে তাহলে কি দিল্লির বার্তায় দেশের রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে?

কিন্তু বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল- বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র কাছে ভারত আসলেই কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলছেন, সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অংশ হিসেবে ভারতের সাথেও ভালো সম্পর্ক আছে আওয়ামী লীগের।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদলে ভারতের ভূমিকা নিয়ে যেসব আলোচনা আছে সেগুলোকে কিভাবে দেখে আওয়ামী লীগ?

এমন প্রশ্নে মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কখনোই এটা মনে করে না। আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সবসময় জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। জনগণ যার পক্ষে থাকবে তারাই জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে। জনসমর্থন যাদের নেই তারাই সবসময় বহির্বিশ্বের কাছে ধর্না দেয় এবং পরনির্ভরশীলতা দেখায়। আওয়ামী লীগ কখনো পরনির্ভরশীলতা দেখানোর প্রয়োজনীয়তা মনে করে না।’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা যে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই সেটি বোঝা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে। মাস ছয়েক আগে তিনি কয়েকবার মন্তব্য করেছিলেন যে, ২০০১ সালে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির প্রতিজ্ঞা করে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল।

এবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সাথে বৈঠকের সময় বিএনপি নেতারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সে প্রতিনিধি দলে ছিলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিএনপির কাছে ভারত কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে ভারতের সাথে যে সম্পর্ক সেটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। অতএব আমরা মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতি, উন্নয়ন, সামাজিক বিষয় সবকিছু ভারতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আমি কোনভাবেই মানতে রাজী নই যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কোন আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করে।’

বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের কাছে ভারতের গুরুত্ব কতটা সেটা খোলামেলাভাবে না বললেও বিশ্লেষকরা মনে করেন এটি নিয়ে এখন আর কোন রাখঢাক নেই।

‘বিভিন্ন সময় অন্য যে শক্তিগুলোর কথা বললাম, তাদের সাথে ভারতের নামটা অবশ্যই আসে। এটাকে লুকোনোর কোন সুযোগ নেই। এটা একেবারেই প্রকট বা প্রকাশিত।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করবে। কারণ আঞ্চলিক রাজনীতির হিসেব-নিকেশ সেটিই ইঙ্গিত করছে বলে তাদের ধারণা।

হঠাৎ সরকার কী খালেদা জিয়ার প্রতি নমনীয় হচ্ছে?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সড়কপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচিকে ঘিরে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে।

এর আগে বিএনপি দীর্ঘদিন ঢাকাসহ সারাদেশে কোথাও প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জনসভা বা সমাবেশের অনুমতি পায়নি, এমন কী ছোটখাটো কর্মসূচিতেও অনুমতি মিলছিল না দলটির জন্য। খবর বিবিসির।

সেই বিএনপিরই চেয়ারপারসন সম্প্রতি লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরার পর শোডাউন করেছে দলটির নেতাকর্মীরা। এরপরেই ঢাকা থেকে অনেকটা রোডমার্চের মতো করেই কক্সাবাজারে গেলেন তিনি, প্রশাসন বা ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে কোনো বাধাও দেওয়া হল না।

তাহলে কি সরকার ও ক্ষমতাসীন দল খালেদা জিয়ার প্রতি এক ধরনের নমনীয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে?
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রায় তিন মাসের সফর শেষে চলতি মাসেই যখন লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরেছিলেন তখন তাকে স্বাগত জানিয়েছিল তার দলের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী ও সমর্থক। তাদের এক ধরনের ‘শোডাউনে’র মধ্য দিয়েই বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসায় পৌঁছেছিলেন তিনি।

তার ফেরার আগে কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়না জারি হয়েছিলো এবং তিনি ঢাকায় ফিরে জামিনের আবেদন করতে যখন আদালতে যান সেখানে আসা-যাওয়ার পথেও হাজির ছিল দলের বিপুল সংখ্যক কর্মী।

এরপর রোহিঙ্গাদের পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণের জন্য তিনি ঢাকা থেকে কক্সবাজার রওনা হলেন, পথে পথে তার দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।

যে বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশের অনুমতিই দেয়া হচ্ছিল না দীর্ঘ সময় ধরে, সেই বিএনপিকে হঠাৎ করে কোনো বাধা ছাড়াই এসব কর্মসূচি পালন করতে দেওয়াটা কি সরকারের কোনো ধরনের নমনীয়তার বহিঃপ্রকাশ?

হলে সেটির কারণই বা কী?
জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন তারাও চান বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করুক কিন্তু অশান্তির কিছু হোক সেটা তারা চান না ।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন দলের কর্মসূচি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। সরকার এ বিষয়ে সব দলকে সহায়তা করবে। কিন্তু কোনো ঘটনা ঘটিয়ে বা নাটক করে ইস্যু বাড়ানোর চেষ্টা করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না।’

যদিও ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা খালেদা জিয়ার এমন সমালোচনা করছেন যাতে বলা হচ্ছে ত্রাণ দেওয়া নয় বরং রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে, অর্থাৎ জনসংযোগে বেরিয়েছেন খালেদা জিয়া।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেকেই দাবি করছেন যে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া যেন সব সুবিধাই পান সেটি নিশ্চিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই। আবার কক্সবাজার যাওয়ার পথে ফেনীতে তার গাড়িবহরের একটি অংশে সাংবাদিকদের গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটলেও বিএনপি নেত্রী বা তার সহযোগীরা পুরো কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন নির্বিঘ্নেই।

এমন কী কক্সবাজারেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘুরে দেখা এবং ত্রাণ বিতরণও তিনি করেছেন পুরোপুরি নির্বিঘ্নেই। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের এমন সহনশীলতা কিংবা নমনীয়তার কারণ কি কেন্দ্রের নির্দেশনা নাকি স্থানীয় সিদ্ধান্ত?

এমন প্রশ্নের জবাবে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা বলেন কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে পাল্টা কোনো কর্মসূচি না দিতে।

তার কথায়, ‘আমরা নিজেরাও সহনশীল। আমরা পাল্টা কিছু করতে চাইনি। তবে মানুষ বুঝেছে এটি ছিলো খালেদা জিয়ার নির্বাচনী কর্মসূচি।’

ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের দপ্তর বিভাগ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী গত বছর পহেলা মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রমিক সমাবেশের পর থেকে গত প্রায় দেড় বছর ধরে তাদের কোনো ধরনের সভা সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছিল না প্রশাসন।

ঢাকার বাইরে কয়েকটি স্থানে কর্মসূচিতে গিয়ে নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন দলটির কয়েকজন সিনিয়র নেতা। ঢাকায় কিছু ঝটিকা মিছিল সমাবেশেও পুলিশি হামলার অভিযোগ প্রায়শই পাওয়া গেছে দলের পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নিউজ টুডে পত্রিকার সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলছেন নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে সরকারের এ নমনীয়তা একটি পরীক্ষা নিরীক্ষাও হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘এবারো যদি আগের মতোই নির্বাচন হয়, বিরোধী দল মাঠে আসতে না পারে তাহলে সরকারের জন্য অসুবিধা হতে পারে। সে বোধ থেকেই হয়তো একটি পলিটিক্যাল স্পেস বিরোধী দলকে দেয়ার বিষয়টা সরকার চিন্তা করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে না চাইলে তো সবাইকে রাজনীতির অধিকার দিতে হবে।’

তবে সে অধিকার ঠিক কতদিন বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি উপভোগের সুযোগ পায় সেটিও পর্যবেক্ষণের বিষয় বলে মন্তব্য করেন আহমেদ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট