১৯শে আগস্ট, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা ভাদ্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:৫৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩১, ২০১৬
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সিলেট থেকে ১২ ঘণ্টার যাত্রা শেষে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন কলেজ ছাত্রী খাদিজা বেগম। লাইফ সাপোর্টে থাকা ওই ছাত্রীকে তিন দফা অস্ত্রোপচারের পর গত বৃহস্পতিবার কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। খাদিজা সুস্থ হয়ে উঠবেন এখন এমন আশা করছেন তাঁর স্বজন ও চিকিৎসকেরা।
প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় খাদিজার এই পরিণতি সমাজে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে, নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে। দেশের সবচেয়ে বড় নারী অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে।
মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, সিলেটে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় খাদিজাকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে, ঢাকার মিরপুরে দুই বোনকে মারধর করা হয়েছে। দিনাজপুরে পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রমাণ হয় সারা দেশে নারী ও শিশুরা দুষ্কৃতকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় নারী ও শিশু নির্যাতন ঠেকাতে সচেতনতা সৃষ্টির আন্দোলন শুরু করব। প্রয়োজনে মহিলা পরিষদের দেড় লাখ কর্মী ঘরে ঘরে যাবে, পুলিশ ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মত বিনিময় করবে।
খাদিজা সুস্থ হবেন, তবে ঝুঁকিমুক্ত নন
গত ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগম পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে সিলেট সরকারি এম সি কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরেই ছাত্রলীগ নেতা ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বহিষ্কৃত ছাত্র বদরুল আলম তাঁকে মাটিতে ফেলে চাপাতি দিয়ে কোপায়।
স্থানীয় লোকজন খাদিজাকে ঘটনাস্থল থেকে যখন উদ্ধার করেন তখন তাঁরাই বদরুলকে গনপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন।
ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিউরোসার্জন রেজাউজ সাত্তার বলেন, খাদিজার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। অস্ত্রোপচারের পর ডান পাশের অনুভূতি দ্রুত ফিরে এলেও বাম পাশটি ছিল অনুভূতিশূন্য। গত কয়েক দিন ধরে খাদিজা বাম পাও নাড়তে পারছেন।
শুরুতে চিকিৎসকেরা আশঙ্কা করেছিলেন খাদিজার বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র শতাংশ। তবে ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। গত দু-তিন দিন ধরে খাদিজা অল্প-স্বল্প কথা বলছেন।
খাদিজার বাবা মাশুক মিয়া জানান, আমি তার দ্বারত (কাছে) গিয়া জিগাইছি আমারে চিনছনি মা? খাদিজা আমারে আব্বু খরিয়া (বলে) ডাকছে।
বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা
গত ৩ অক্টোবর স্থানীয় বাসিন্দারা বদরুল আলমকে পুলিশে সোপর্দ করেন। একদিন পর সে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে খাদিজাকে কুপিয়ে জখম করার কথা স্বীকার করে। আসামি স্বীকার করে নেওয়ার তিন সপ্তাহ পরও পুলিশ অভিযোগপত্র জমা না দেওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে বিভিন্ন মহল।
খাদিজার ভাই শাহীন আহমেদ বোন সুস্থ হয়ে ওঠায় চীনে ফিরে গেছেন। চীনের একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্র শাহীনের সঙ্গে স্কয়ার হাসপাতালের লাউঞ্জে বসে কথা হয় গত শনিবার।
বেনারকে শাহীন বলেন, “আমরা বিশ্বাস করতে চাই বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে আমাদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।” তাঁর মতে, বিচার না হলে এ ধরনের অপরাধ ঘটতেই থাকবে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিচার না হওয়ার আশঙ্কা এ দেশে মোটেও অমূলক নয়। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বড় সংখ্যক নারী বিচার পান না।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার বলছেন, খাদিজার এই ঘটনার বিচার হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, সরকারি দলের কর্মী হলেও সে রেহাই পাবে না। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও সে পাবে।
সাজার হার দশমিক ৪৫!
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) পরিচালনা করছে। ওসিসি নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু চিকিৎসা, আইনগত সহায়তা ও পুনর্বাসন সহায়তা দিয়ে থাকে।
২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওসিসির হিসেবে দেখা গেছে, নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় ২২ হাজার ৩৮৬জন চিকিৎসা নিয়েছেন।
এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার ৩টি, রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। শতকরা হিসেবে রায় ঘোষণার হার ছিল ৩ দশমিক ৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ।
ওসিসির প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, নির্যাতনের শিকার নারী ও তাঁর স্বজনেরা নিজেদের ঘটনার শিকার মনে না করে প্রায়ই নিজেদের দোষী ভাবেন। তার মতে, সমাজব্যবস্থাটা এমনই যে একবার যিনি নির্যাতনের শিকার হন তিনিই জীবনভর নির্যাতিত হতে থাকেন। তাঁর দিকেই মানুষ আঙুল তোলে।
বিচার চান না অনেকেই
গত রোববার রাতে রাজধানীর দক্ষিণখানে এক কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ওসিসিতে আসেন। তাঁর মামলাটির দেখভাল করছেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার।
ফাহমিদা বলেন, ওই কিশোরীর মা শুধু চিকিৎসা সহায়তা চান। তিনি বিচার চান না। তাঁর আশঙ্কা মামলা হলে তাঁর মেয়ে ভবিষ্যতে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে না।
কমপক্ষে ১০টি আলোচিত মামলা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন সমাজর দুর্বল অংশের মানুষেরা। বিচারকালীন সময় রাষ্ট্র তাঁদের পাশে দাঁড়াবে এই আস্থার অভাব আছে তাঁদের।
এ বছরের প্রথম ভাগে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যশিল্পী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। এই ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
গত রোববার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ বলেন, তনুর মা বিভিন্ন সময় আক্ষেপ করছেন। কিন্তু আমরা বলব তদন্ত পদ্ধতিগতভাবে ঠিকমতো আগাচ্ছে। সন্দেহভাজন সেনা সদস্যদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে মেলানো হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি।
তনু হত্যাকাণ্ডের রেশ না কাটতেই আক্রান্ত হয়েছেন খাদিজা। খাদিজা যখন স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সেই একই সময়ে রংপুর সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়েছিল দিনাজপুর থেকে আসা পাঁচ বছরের এক শিশু।
ওই শিশুর বাবা বলেন, হলুদ খেতে পড়েছিল আমার মেয়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। জ্ঞান ফিরতে যার নাম বলেছে তাকে সে বড় আব্বু বলে ডাকে।
ওই ঘটনায় পার্বতীপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার আদালত ওই ঘটনার মূল আসামি সাইফুলের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারির বিভাগীয় প্রধান আশরাফুল হক কাজল বলেন, শিশুটি মানুষ দেখলে চিৎকার করে উঠছে। তার প্রজনন অঙ্গে পোকা ধরে গেছে। যে সংক্রমণ হয়েছে তা ঠিক হতে কমপক্ষে দুই মাস লাগবে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরে ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতি পুলিশকে জিরো টলারেন্সে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক।
অভিযোগ আছে পুলিশ সময় মতো সাক্ষী হাজির করে না। ক্ষমতাবান হলে তাদের ধরায় উদ্যোগী হয় না। তবে পুলিশ বলছে, দায় সরকারি কৌঁসুলিদের। তাঁরাই এসব মামলার গতি বাড়াতে উদ্যোগী হন না।
অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টি আমি নিজে তদারক করি। উদ্যোগের অভাব আছে এ কথা বলা যাবে না।
সমস্যাটা আসলে কোথায়? সমাজে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ভেতরে না বিচার ব্যবস্থায়? কেউই দায় নিতে চায় না। আর পরস্পর দায় চাপানোর এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়েই চলেছেন।
EDITOR & PUBLISHER :
DR. ARIF AHMED MOMTAZ RIFA
MOBILE : 01715110022
PHONE : 0821 716229
Executive Editor : M A Malek
Office : Central Market (1st floor),
Bandar Bazar (Court Point),
Sylhet – 3100, Bangladesh.
E-mail : sylhetsangbad24@gmail.com
Hello : 01711912127
Design and developed by M-W-D