‘সাংবাদিকতা রাত বিরাতে’ বাস্তব জীবনের আখ্যান

প্রকাশিত: ১১:৫৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৫, ২০১৯

‘সাংবাদিকতা রাত বিরাতে’ বাস্তব জীবনের আখ্যান

একেএম রাশেদ শাহরিয়ার : কাজ করতে গেলে প্রচুর শিখতে হয়। কারণ সঠিক জ্ঞান না থাকলে তার প্রয়োগও ‍সঠিক হয় না। এ কথা সব পেশার জন্যই প্রযোজ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) জিওগ্রাফি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন মাসুদ হোসেন। ঢাবিতে যোগ দেয়ার আগেই আমরা দুজন বন্ধু বনে যাই এক রুমে থাকতাম বলে। বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে একটি সরকারি কলেজে তখন জিওগ্রাফির তরুন শিক্ষক মাসুদ।

প্রায়ই দেখতাম রাত জেগে প্রচুর পড়াশোনা করছে। পরদিন শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবে তা তৈরি করাই ছিল তার প্রধান কাজ। ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’ এই প্রবাদে আমিও আসক্ত হলাম। বই পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু সাংবাদিকতায় বাংলায় তেমন ভালো বই তখন ছিল না। বাংলায় কাজ করি বলে ইংরেজি বইয়ের প্রতি আকর্ষণও বোধ করতাম না।

শিল্পমান যাই থাকুক পাঠক হিসেবে আমি মাসুদ রানা সিরিজের ভক্ত ছিলাম। এর মূল কারন এটা পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে কষ্ট হতো। তখনই আফসোস হতো সাংবাদিকতার বইগুলো যদি এমন হতো। আকর্ষণ ধরে রেখে যদি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পারতাম?

আমার তরুন বয়সের সেই তৃষ্ণা বা আফসোস মধ্য বয়সে এসে অনেকটা মিটিয়েছে ‘সাংবদিকতা রাত বিরাতে’ বইটি।

বইটি লিখেছেন মাহফুজুর রহমান। তিনি ইউএনবির সম্পাদক। ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন সন্তানের জনক। দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। সত্যিকার অর্থে একজন সাংবাদিক তার পরিবারকে সুখি করার সময়-সুযোগ পান না। রাত-বিরাতে কাজ করতে হয় বলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের কাছে না পাওয়ার বেদনা থাকে। তবে মাহফুজ ভাইয়ের পরিবারকে সে ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতে কখনো দেখিনি।

লেখক মাহফুজুর রহমানকে এই প্রথম চিনলেও সাংবাদিক মাহফুজুর রহমানকে চিনি দু’বছরের অধিক সময় ধরে। তারও আগে থেকে একজন ক্ষুদ্র সংবাদ শ্রমিক হিসেবে তাঁকে জানতাম। তবে সেভাবে আমাদের পরিচয় ঘটেনি। আমি ইউএনবিতে মফস্বল সম্পাদক হিসেবে যোগ দেয়ার আগে থেকেই ইউএনবির বাংলা বিভাগ চালুর ঘরোয়া প্রক্রিয়া চলছিল। আমি যোগ দেয়ার দু’মাসের মাথায় বাংলা সার্ভিসের হেড চলে যাওয়ায় এ গুরু দায়িত্বটাও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে আমার কাঁধে চলে আসে।

তখন ওনাকে ভালোভাবে চেনার সুযোগ হয় একজন প্রশিক্ষক হিসেবে। বাংলার সহকর্মীদের ইন-হাউজ প্রশিক্ষণের আয়োজন করি। সপ্তাহে একদিন সেই ক্লাসটি নিতেন তিনি। ক্লাস নেয়ার কৌশল এত আকর্ষণীয় ছিল যে, আমি নিজেও সে সময় প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করি।

যখন শুনলাম তিনি বই লিখবেন তখনই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। মাহফুজ ভাই স্রোতের বিপরীতের মানুষ। কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছু করেন না। শতভাগ পেশাদারিত্বের ছোঁয়া সবকাজে পাওয়া যায়।

‘সাংবাদিকতা রাত বিরাতে’ বইটির প্রথমগুণ এর নির্ভুল উপস্থাপনা। ‘ছাপাখানার ভূত’ বলে যে একটা কথা প্রচলিত আছে, এই বইটির ক্ষেত্রে এমনটি ধারণা করার সুযোগ নেই। পুরো বইটি দু’বার পড়ার পরও আমার শুধু একজন অধ্যাপকের নামের সামান্য ভুল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি।

বইটি মজার হয়েছে অন্য কারনে। লেখক তার কথায় অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি ছিলেন বক্তা। একজন তার কথা শুনে শুনে লিখেছেন। এতে পাঠকদের জন্য যেটা উপকার হয়েছে সেটা হলো, একটা গল্পই উপহার পাচ্ছে। গতানুগতিক বইয়ে যে ধরনের কাঠিন্য থাকে তা এই বইয়ে নেই।

সত্যকে এই বইয়ে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন ভূমিকায় তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, “…..সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়টি খুব যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং যা করতে হবে, তাদের মতে, তাতে ভারসাম্য রক্ষা করা।”

বইটির নাম কেন সাংবাদিকতা রাত বিরাতে তার যুক্তিও তুলে ধরেছেন তিনি। অন্য পেশার সাথে সাংবাদিকতার পেশা যে মিলানো যায় না এটাও বইটিতেই স্পষ্টতঃ ফুটে উঠেছে।

বইটির মজার দিক হলো, যে কেউ চাইলে এটিকে পার্ট পার্ট করে পড়তে পারেন। এর অধ্যায়গুলো সাজানো হয়েছে ছোট ছোট কলেবরে। যেমন, সংবাদ কি এবং কেন?, সাংবাদিকতা মাঠে ময়দানে, সাংবাদিকতা ডিজিটাল যুগে, সংবাদ কক্ষ ও শ্রেণি কক্ষ, পরাবাস্তব সাংবাদিকতা, আমি সাংবাদিক, সাংবাদিকতার স্ব্প্নসাধ এরকম নানা নামে। বইটিতে এ রকম ২৪টি ছোট ছোট অধ্যায় রয়েছে। যা ব্যস্ত পাঠকদের জন্য উপকারী।

সাংবাদিক ছাড়াও যে কেউ পড়লে এ জন্যই মজা পাবেন, কারণ বইটি গল্পের ঢংয়ে লেখা। পাঠক মনে করবেন, তিনি একজন সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার গল্প পড়ছেন।

ভাষার মুন্সিয়ানা, ছবির চমক বা শিরোনামই শিরোপা এসব একটা শ্রেণি কক্ষে পড়ানোর বিষয়। তাই বইটি অচিরেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষে পড়ানো শুরু হলে তাতে অবাক হবো না।

‘আমি সাংবাদিক’ বলে সাংবাদিকদের অহমিকার বিষয়টি তিনি যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি সাংবাদিকদের বিবেক শিরোনামে তিনি জানান দিয়েছেন, একজন সাংবাদিককে আসলে কেমন হওয়া উচিত।

সাংবাদিকতার বা সংবাদ মাধ্যমের যে ক্রান্তিকাল চলছে, তা নিয়েও লেখকের ভাবনা ফুটে উঠেছে বইটিতে।

এক কথায় সংবাদ জগত, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ সবার আগ্রহ মেটাবে এই বইটি। বইটিতে সুকৌশলে, গল্পের ছলে, সবার চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।

বইটির পরবর্তী সংস্করণে কয়েকটা কেস স্টাডি থাকলে, পাঠক অনেক মজা পাবে। বইটি বর্তমানের আধুনিক পাঠকদের তৃষ্ণা মেটাবে এই কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।

সাংবাদিকতা রাত বিরাতে বইটি প্রকাশ করেছে রিদম প্রকাশনা সংস্থা। নান্দনিক কভার পেজে বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ২৫০ টাকা। তবে একজন পাঠক চাইলেই বইটি ২০০ টাকায় সংগ্রহ করতে পারবেন। বইটি বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং কলকাতার বাজারে একযোগে পাওয়া যাচ্ছে। রকমারি ছাড়াও বাংলাদেশে বইটি সংগ্রহ করার জন্য ০১৭১২৫৯১৮২২ এই নাম্বারে ফোন করা যেতে পারে।

লেখকঃ মফস্বল সম্পাদক ও বাংলা বিভাগের প্রধান, ইউএনবি

সর্বমোট পাঠক


বাংলাভাষায় পুর্নাঙ্গ ভ্রমণের ওয়েবসাইট