লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক

প্রকাশিত: ১:৫৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১১, ২০১৯

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক

ইসলামের ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে গতকাল ছিল এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। বিশ্বের কমপক্ষে ২০ লাখ হজযাত্রী আজ দু টুকরো সাদা কাপড়ে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেন। এক সুরে তারা মুহুর্মুহু উচ্চারণ করছেন ‘লাব্বাইক  আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নিয়ামাতা, লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাকা।’ অর্থাৎ- হাজির হে আল্লাহ হাজির, আপনার মহান দরবারে হাজির। আপনার কোনো শরিক নেই। সব প্রশংসা, নিয়ামত এবং সব রাজত্ব আপনারই।
গতকাল ভোর থেকেই আরাফাতের ময়দানে ঢল নামে হজযাত্রীদের। সকালের আলো ফোটার আগেই সেখানে সমবেত হওয়া শুরু করেছেন তারা। এর আগে শুক্রবার তারা তাঁবুর শহর বলে পরিচিত ঐতিহাসিক মিনায় সমবেত হন। সেখানে ইবাদত বন্দেগিতে সময় অতিবাহিত করেন। আর গতকাল ছিল আরাফাত দিবস। এদিন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এই ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এদিনটিকে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার দিন হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, এটাই হলো হজ।
সৌদি আরবের অনলাইন আরব নিউজ লিখেছে, পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে শুক্রবার। এদিন মিনায় উপস্থিত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ লাখ হজযাত্রী। এখান থেকে গতকাল তারা ছুটে যান পবিত্র আরাফাতের ময়দানে, যা পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। এখানে হজযাত্রীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, সকল ভেদাভেদ ভুলে আবেগঘন দিন অতিবাহিত করেন। মহান আল্লাহর দরবারে নিজেকে সঁপে দিয়ে ইবাদত করেন। এই আরাফাতের ময়দানে এ দিনে মহানবী (স.) তার বিদায় হজের ভাষণে সমতা ও সকল মুসলিমের ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ফরজ। কেউ এই সময়ের মধ্যে এই ময়দানে অবস্থান করতে না পারলে হজ আদায় হবে না। এই ময়দানে জোহরের সময় পর পর জোহর ও আসরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেন হাজীরা। মুসাফির হওয়ার কারণে নামাজ কসর করেন (চার রাকাতের স্থলে দুই রাকাত)। নামাজের আগেই মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা দেন নির্ধারিত খতিব। এর আগে পরে হজযাত্রীদের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হবে পুরো ময়দান। আমির-ফকির, ধনী-গরিব, সাদা-কালোর ভেদাভেদ থাকবে না সেখানে। সবার পরনে একই ধরনের সেলাইবিহীন কাপড়, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং তারই কাছে গুনাহ মাফ ও রহমত প্রাপ্তির আকুতি।
সূর্যাস্তের সাথে সাথেই আবার মিনায় ফেরার পথে মুজদালিফা নামক স্থানে রাতে অবস্থান নেন হাজীরা। ওই স্থানে রাতে অবস্থান করবেন খোলা আকাশের নিচে। সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ এক সাথে আদায় করেন। মিনায় জামারাতে শয়তানের প্রতিকৃতিতে নিক্ষেপের জন্য এখান থেকেই কঙ্কর সংগ্রহ করেন তারা। রাতে সেখানে অবস্থানের পর কাল ১০ জিলহজ রবিবার ফজরের নামাজ শেষে সূর্যাস্তের আগেই মিনার দিকে রওনা হবেন। আজ ১১ আগস্ট রবিবার সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। মিনায় গিয়ে জামারাতে রবিবার বড় শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ এবং কোরবানি করবেন। মিনায় কোরবানি করার পর হাজীরা মাথা মুন্ডন করে অথবা চুল ছোট করে ইহরাম ভেঙে ফেলবেন। এরপর তাওয়াফে জিয়ারাহ করার জন্য মক্কায় যাবেন। সেখানে হেরেম শরিফ সংলগ্ন সাফা-মারওয়া নামক পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে দৌড়াবেন (সায়ি করবেন)। জিলহজের ১১, ১২ তারিখ মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করার নিয়ম। ১২ জিলহজ হজের আনুষ্ঠানিক কার্যাদির সমাপ্তি ঘটবে। কেউ ১২ তারিখ মিনা ত্যাগ না করলে ১৩ তারিখও তাকে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই পাঁচ দিনের হজের কার্যাদি সম্পন্ন করবেন হাজীরা।
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা একজন হাজীর জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। এই অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ। হাজীরা এই দিনটিসহ পুরো হজকার্য সম্পাদনের জন্য আজীবন স্বপ্ন লালন করেন।
হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল (সা:) বলেছেন, এমন কোনো দিবস নেই যেখানে আল্লাহ তায়ালা আরাফাহ দিবস থেকে বেশি বান্দাহকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন এবং আল্লাহ নিশ্চয় নিকটবর্তী হন ও তাদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন, বলেন, ওরা কী চায়? (মুসলিম)। আরেক হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা আরাফায় অবস্থানরতদের নিয়ে আকাশবাসীদের সাথে গর্ব করেন।
তিনি বলেন, আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা আমার কাছে এসেছে আলুথালু ও ধুলায় আবৃত অবস্থায়। (মুসনাদে আহমাদ)
আরাফাতের ময়দান দোয়া কবুলের জায়গা। এখানেই আদি পিতা হজরত আদম ও হাওয়া (আ:)-এর পুনর্মিলন হয়েছিল এবং তাদের দোয়া কবুল হয়েছিল মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ময়দান রাসূল (সা:)-এর বিদায়হজের ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত। সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজীরা বিভিন্ন গ্রুপে এবং আলাদা আলাদাভাবে দোয়া করতে থাকেন। এ সময় অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করেন হাজীরা। গুনাহ মাফের আকুতি ছাড়াও জীবনের সব চাওয়াই আল্লাহর দরবারে পেশ করেন। সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান ত্যাগের সময় নিজেকে নির্ভার-নিষ্পাপ জ্ঞান করে মুজদালিফার দিকে এগোতে থাকেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ছুটে যাওয়া তারা।
হজরত আদম (আ:) কর্তৃক নির্মিত পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবাকে কেন্দ্র করেই মূলত হজের কার্যাদি। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ:) ও তার পুত্র ইসমাইল (আ:) এই কাবাঘর পুনর্র্নিমাণ করেন। হজের অধিকাংশ কাজই হজরত ইবরাহিম (আ:), তার স্ত্রী হাজেরা এবং পুত্র ইসমাইল (আ:)-এর সম্পাদিত কাজের সাথে সম্পর্কিত। মুসলমানেরা পশু কোরবানি আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে ইবরাহিম (আ:) কর্তৃক স্বীয় শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করতে যাওয়ার মহান ত্যাগের ঘটনার সাথে সম্পর্কিত।
হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম এবং সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ।
এ বছরও ২৫ লাখের বেশি মুসল্লি পবিত্র হজ পালন করছেন, যা গত বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি। এর মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজীর সংখ্যা ১৮ লাখ ১৭ হাজার। বাকি হজযাত্রীরা সৌদি আরবের। এ বছর বাংলাদেশি হজযাত্রীর সংখ্যা এক লাখ ২৭ হাজার ১৫২ জন। হিজরি মাস গণনায় সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের একদিনের পার্থক্য রয়েছে। এই হিসাবে আজ (গতকাল) সৌদি আরবে ৯ জিলহজ অর্থাৎ হজের দিন হলেও বাংলাদেশ আজ ৮ জিলহজ। বাংলাদেশে আগামী সোমবার ১০ জিলহজ পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। পশু কোরবানি করবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।

হজযাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে সব রকম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আল্লাহর এসব মেহমানকে সেবা দিতে পেরে গর্ব প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা বিষয়ক মুখপাত্র বাসাম আত্তিয়া। ওদিকে হজ করতে যেতে পেরে সন্তুষ্টি, শুকরিয়া প্রকাশ করেছেন অনেকে। তার মধ্যে পাকিস্তানের মোহাম্মদ জামিল অন্যতম।
তিনি বলেন, এ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। সারা জীবন এই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করেছি। খুব খুশি লাগছে। আমরা সারাবিশ্বের মুসলিমের জন্য প্রার্থনা করছি। বিশেষ করে কাশ্মীর, ফিলিস্তিনের মতো বিভিন্ন স্থানে যেসব ভাইবোন সমস্যার মধ্যে আছেন তাদের জন্য দোয়া করছি। তাদের সবার জন্য দোয়া করছি। দোয়া করছি পরিবার ও প্রিয়জনদের জন্য। সৌদি আরবের নাগরিক রাহাফ নিয়াজি প্রথমবার হজ করছেন। তিনি বলেছেন, এখন পর্যন্ত সব কিছুই চমৎকার দেখছি। হজ করতে পেরে শুকরিয়া আদায় করছি।