‘কাল্পনিক’ মামলার রিটে হাইকোর্টের বিভক্ত আদেশ

প্রকাশিত: ৮:৪০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৯, ২০১৮

‘কাল্পনিক’ মামলার রিটে হাইকোর্টের বিভক্ত আদেশ

সারাদেশে বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা ‘কাল্পনিক’ মামলা নিয়ে রিটের ওপর বিভক্ত আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

মঙ্গলবার বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশসহ রুল জারি করলেও অপর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রিট খারিজ করে আদেশ দেন। নিয়ম অনুসারে বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হবে। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি সুরাহার জন্য একটি একক বেঞ্চ (তৃতীয় বেঞ্চ) গঠন করে দেবেন।

গত সোমবার এ রিটের ওপর শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন। মঙ্গলবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানি করেন। উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, মাহবুব উদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট মাসুদ রানা, ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান প্রমুখ।

২৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী ও সানা উল্লাহ মিয়া এ রিট দায়ের করেন। এ তিনজনের মধ্যে খন্দকার মাহবুব হোসেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, নিতাই রায় চৌধুরী বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী এবং সানাউল্লাহ মিয়া বিএনপির আইন সম্পাদক।

মঙ্গলবার শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বিষয়টি হলো ফৌজদারী। এই ফৌজদারীর ব্যাপারে যে বিধি-বিধান আছে, সে অনুযায়ী মামলায় প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সুতরাং এই মামলাগুলোর ব্যাপারে রিট আবেদন চলবে না। এই কথা বলে আমি উচ্চ আদালতের নজির উপস্থাপন করেছি।

তিনি বলেন, পত্র পত্রিকায় এসেছে মৃত ব্যক্তির নামে মামলা হয়েছে। আমার বক্তব্য হলো জীবিত না মৃত তা তদন্ত করবে আইন শৃংখলা বাহিনী। পরে খন্দকার মাহবুব হোসেন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

পরে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশসহ রুল জারি করেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুসারে আবেদনকারীদের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অসংখ্য মানুষের বিরুদ্ধে কথিত ‘কল্পিত’ ফৌজদারি মামলা করা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বর্হিভুত ঘোষণা করা হবে না এবং এ ধরনের ‘কল্পিত’ মামলা দায়ের সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

একইসঙ্গে ঢাকা মহনগর এলাকায় আবেদনকারীসহ ও অন্যদের বিরুদ্ধে হওয়া কথিত ‘কল্পিত’ মামলাগুলো তদারকি করতে ও অনুসন্ধানে পদক্ষেপ নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আদেশ পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

জ্যেষ্ঠ বিচারপতির ঘোষিত আদেশে বলা হয়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আইন অনুসারে মুক্তভাবে তদন্তকাজ পরিচালনা করতে পারবেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার (নর্থ জোন), রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনারসহ ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে রিট আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন বেঞ্চের অপর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। আদেশে এ বিচারপতি বলেন, রিট আবেদনকারী (৩ জন) নিজেই ফৌজদারী এসব মামলার আসামি। সুতারাং ফৌজদারি মামলার আসামি জনস্বার্থে বা সংক্ষুব্ধ হয়ে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিট আবেদন করার এখতিয়ার নেই। এছাড়া এ বিষয়ে আপিল বিভাগেরও সিদ্ধান্ত রয়েছে। আর সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত মানতে হাইকোর্ট বাধ্য। তাই প্রাথমিক শুনানি অন্তে এই রিট আবেদনটি সরাসরি প্রত্যাখান করা হলো।

আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসের ১১, ১২, ১৩, ১৫ এবং ১৬ তারিখে কতগুলো মামলা হয়েছে। এসব মামলায় খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরীর নামও উল্লেখ আছে। এসব মামলাগুলোকে যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা মামলা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এ ধরনের মামলা যেন আর না হয়, তা চেয়ে রিট আবেদন করেছিলেন।

তিনি বলেন, সোমবার ও মঙ্গলবার এই রিটের শুনানি হয়েছে। ড. কামাল হোসেন দরখান্ত করে এই রিটের পক্ষে শুনানি করেছেন। আমি আজ আমার শুনানিতে বলেছি, বিষয়টি হলো ফৌজদারী। এই ফৌজদারীর ব্যাপারে যে বিধি-বিধান আছে, সে অনুযায়ী মামলায় প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সুতরাং এই মামলাগুলোর ব্যাপারে রিট আবেদন চলবে না। এই কথা বলে আমি উচ্চ আদালতের নজির উপস্থাপন করেছি। শুনানি অন্তে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী আসামিদের প্রার্থনা মতে রুল জারি করেছেন এবং আইজিপিকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

অপরদিকে বিচারপতি আশরাফুল কামাল রিট আবেদনটি রক্ষনীয় নয় বলে খারিজ করে দিয়েছেন। দুজন বিচারপতির দুরকম অভিমত দেওয়ায় পরিপ্রেক্ষিতে এটা প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে এবং তিনি এটা তৃতীয় বিচারপতির কাছে পাঠাবেন।

অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, যেহেতু প্রিজাইডিং জাজ (নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি) রুল দিয়েছেন, তাই সুপ্রিমকোর্ট রুলস অনুযায়ী তৃতীয় বিচারপতি রিট আবেদনটি নিষ্পত্তি না করা পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ বিচারপতির আদেশটি কার্যকর থাকবে, এবং আদেশ অনুযায়ী পুলিশও তা প্রতিপালন করবে।

এ বিষয়ে বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, না, এ আদেশ কার্যকর করার কোনো উপায় নাই। তৃতীয় বিচারপতি যে সিদ্ধান্ত দিবেন সেটাই হবে মামলার আদেশ।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন অ্যাডভোকেট এ কে খান। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, সানাউল্লাহ মিয়ার পক্ষে এই রিট দায়ের করা হয়। রিটে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সারাদেশে বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবীসহ বিভিন্ন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা চার হাজার মামলা এবং তিন লাখেরও বেশি লোককে আসামি করার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, এ বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।

এছাড়া, আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত যত গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর তদন্ত বন্ধ এবং এসব গায়েবি মামলার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কমিটি গঠন করে ঘটনার তদন্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে যেন এ ধরনের মামলা দেওয়া না হয়, তার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অগণিত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করে গায়েবি বা আজগুবি মামলা দায়ের করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, রিটে সে বিষয়ে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের আইজি, ডিএমপি কমিশনার, ডিএমপি রমনা জোনের ডেপুটি ও অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার, রমনা, পল্টন ও শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ মোট নয়জনকে রিটে বিবাদী করা হয়।