ভয়াবহ সুনামিতে ইন্দোনেশিয়ায় মানবিক বিপর্যয়, সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে

প্রকাশিত: ১:১৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২, ২০১৮

ভয়াবহ সুনামিতে ইন্দোনেশিয়ায় মানবিক বিপর্যয়, সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে

 

জাকার্তা: ইন্দোনেশিয়ায় ভয়াবহ সুনামিতে নিহত ব্যক্তিদের মৃত দেহগুলোকে সৎকার করার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানের অভাবে দেশটির স্বেচ্ছাসেবীরা সেগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে শুরু করেছেন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ইন্দোনেশিয়া এখনো পর্যন্ত যথাযথ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তবে জাকার্তার সরকারি কর্মকর্তারা এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি দেশটিতে ভয়াবহ সুনামির ফলে অন্তত ৮৪৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। একই সাথে অন্তত ৪৮,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন।

ভয়াবহ এই সুনামির পাঁচদিন পরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো পর্যন্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী এবং ঔষধ পৌঁছেনি। উদ্ধার কর্মীরা অপর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নিয়েই উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রথমেই সুনামিতে ধ্বংস হওয়া বিভিন্ন দালানে আঁটকে পড়াদের উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো জীবন রক্ষাকারী সহায়তা দিতে প্রস্তুত এমন বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওর জন্য তার দেশের দরজা খুলে দিয়েছেন।

ইন্দোনেশিয়ার একজন সরকারি কর্মকর্তা সোমবার এক টুইট বার্তায় বলেন- ‘গত রাতে প্রেসিডেন্ট উইডোডো আমাদের প্রতি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা গুলোকে এই বিপর্যয়ে সাহায্য করার জন্য ইন্দোনেশিয়াতে প্রবেশে সহায়তা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।’

ইন্দোনেশিয়াতে এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার জন্য ১৪ দিনের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

পালু নামের ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র উপকূলের শহরের স্বেচ্ছাসেবীরা একটি বৃহৎ কবর খুঁড়েছেন। এ কবরটি এমনভাবে খুঁড়া হয়েছে যাত করে তারা সেখানে অন্তত ১,৩০০ মৃতকে কবর দিতে পারেন।

গত মাসের ২৮ তারিখে পালু শহরে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয় এবং এর ফলে সেখানে ভয়াবহ সুনামি দেখা দেয়। জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা সংস্থার বরাত দিয়ে জানা যাচ্ছে যে, ভয়াবহ ওই সুনামিতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮৪৪ জন নিহত হয়েছে। শহরটির বেশীরভাগ দালান ভেঙ্গে পড়েছে এবং মারাত্মক বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে।

বেঁকে যাওয়া পরিত্যক্ত ভূমি

পালু শহরটির বালারোয়া নামের একটি উপশহর যেখানে বেশ কিছু বছর যাবত বড় বড় দালান গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এই বালারোয়ার উপ-শহরটির বেশির ভাগ দালানই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

উদ্ধারকারীরা গড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তাদের কাছে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব রয়েছে। উদ্ধারকারীদের একজন জানিয়েছেন যে, পালুর একটি হোটেলে অন্তত ৬০ জন মানুষ আটকা পড়েছে।

রোয়া-রোয়া নামের আরেকটি হোটেল থেকে উদ্ধার হওয়া দুইজন ব্যক্তি জানিয়েছেন- সেখানে এখনো আরো বেশ কয়েকজন আটকা পড়ে আছেন।

দুর্যোগের স্বীকার হওয়া অনেককেই স্থানীয় খাবার দোকানগুলো থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

বার্তা সংস্থা এএফপিকে স্থানীয় একজন জানান- ‘এখানে কোনো প্রকার সাহায্য পোঁছেনি, আমাদের খাবার দরকার। আমাদের কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই, আমাদের অবশ্যই খাবার সংগ্রহ করতে হবে।’

ইতোমধ্যে সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, পালু শহরটির তিনটি জেলখানা থেকে অন্তত ১,২০০ জন বন্দি পালিয়ে গেছেন।

বেঁচে যাওয়া অনেকেই তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয় স্বজনদের খোঁজে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।

সুনামিতে বেঁচে যাওয়া আদি নামের একজন বলেন, ‘আমরা যখন সমুদ্রতটে ছিলাম তখন সুনামি আরম্ভ হয় এবং আমি আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম কিন্তু তাকে আমি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারিনি। আমি এখন জানি না সে কোথায় আছে।’

স্থানীয় মেট্রো টিভিতে দেখা যায় যে, ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ উপকূল পেটোবো নামক একটি শহর সুনামির ফলে মারাত্মক ক্ষতি সম্মুখীন হয়েছে।

সরকারি এক হিসেব মতে, সেখানে ৭০০ মানুষের বেশী নিহত হয়েছেন এবং অন্তত ১,৭৪৭ টি বাড়ি ঘর ধ্বংস হয়ে গেছে।

বন্দর, সেতু, রাস্তা সবকিছুই ভেঙ্গে পড়েছে

ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিস নামের একটি উদ্ধারকারী সংস্থার ইয়েনি সুরিয়ানি নামের একজন কর্মী বলেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামোর জন্য উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘মানবিক সংস্থাগুলো আক্রান্ত এলাকা থেকে জনগণকে বের করে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পালু শহরের প্রধান বিমান বন্দরটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, রাস্তাগুলো ভেঙ্গে গিয়েছে এবং সকল প্রকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।’

স্থানীয় বিমান বন্দরটিকে দ্রুত সারিয়ে তোলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে যাতে করে সেখানে মানবিক সাহায্য পৌঁছানো যায়। তবে বিপত্তি ঘটেছে রাস্তা-ঘাঁটগুলো নিয়ে কেননা এগুলোর অধিকাংশই ভেঙ্গে পড়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত রাস্তা-ঘাঁটগুলো সারিয়ে তুলতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

উপগ্রহ থেকে পাওয়া বিভিন্ন আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, আক্রান্ত এলাকার সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, সেখানকার বড় বড় জাহাজগুলো ভূমিতে আছড়ে পড়ে রয়েছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বসে পড়েছে।

দ্বি-খিলান বিশিষ্ট হলুদ একটি সেতু এমনভাবে ভেঙ্গে পড়েছে যে, এর উপরে থাকা গাড়িগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেঁকে পড়ে রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ইন্দোনেশিয়া ২৬০ মিলিয়ন মানুষের এমন একটি দেশ যাকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগ প্রবণ এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়।

এই দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যাকে ‘Ring of Fire’ বলা হয় যেখানে টেকটোনিক প্লেটগুলো এমনভাবে অবস্থান করছে যে কোনো সময় দেশটিতে ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা রয়েছে।

এছাড়াও দেশটি এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে বিশ্বের ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি সমূহের অবস্থান রয়েছে।

২০০৪ সালে মারাত্মক এক ভূমিকম্পের ফলে অঞ্চলটিতে ভয়াবহ এক সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল যার ফলে অন্তত ২২০,০০০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং এর মধ্যে অন্তত ১৬৮,০০০ জন ছিল ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক।

সূত্রঃ এমএসএন ডট কম