‘জনসম্মুখে হিজাব খুলতে বাধ্য করার দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমাকে সারা জীবন বইতে হবে’

প্রকাশিত: ১২:৩৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮

‘জনসম্মুখে হিজাব খুলতে বাধ্য করার দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমাকে সারা জীবন বইতে হবে’

সোহা ইলকুত: যেদিনটি আমার জন্য সেরা একটি দিন হতে পারতো সেদিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিনে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। যখন আমি তুলসা(যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা শহরের একটি শহর) এর আদালতে আমার স্বামীর সাথে তালাক হয়ে যাওয়াকে কার্যকর করতে যাই, আমাকে আদালতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তারা এমনটি করেছে কারণ আমি একজন মুসলিম নারী। এ ঘটনায় আমি অপদস্থ, অপ্রস্তুত এবং দ্বিধান্বিত হয়ে যাই।

আমার মাথায় হিজাবের সাথে একটি চুলের ক্লিপ থাকার কারণে আদালতে প্রবেশের সময় মেটাল ডিটেক্টর শব্দ করে উঠে এবং সাথে সাথেই কর্তব্যরত কর্মকর্তারা আমাকে হিজাব খুলে ফেলতে নির্দেশ দেয়। এর পর থেকেই আমার এই দুঃস্বপ্নের শুরু হয়। আমার আইনজীবী এবং আমি কর্মকর্তাদের ভদ্র ভাষায় বোঝাতে চেষ্টা করি যে, আমি হিজাব পরিধান করি ধর্মীয় কারণে এবং জনসমাগম স্থানে ও পুরুষদের সামনে আমি আমার হিজাব খুলে ফেলতে পারবো না।

আমি সহ অন্যান্য মুসলিম নারীদের জন্য আমাদের হিজাব হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পোশাক। আমরা এটি পরিধান করি শিষ্টতা বজায় রাখতে যা সৃষ্টিকর্তার সাথে আমাদের যোগাযোগকে নির্দেশ করে।

আমি গর্বের সাথে হিজাব পরিধান করি, কারণ এর মাধ্যমে আমি আমার ধর্মের সাথে এবং সমাজের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি। জনসমাগম স্থলে একজন পুরুষ কর্তৃক আমার হিজাব খুলে ফেলার নির্দেশ অনেকটা তার সামনে আমার পোশাক খুলে ফেলার নির্দেশ দেয়ার মতই।

কর্তব্যরত অফিসারটি আমাকে জানায় যে, অবশ্যই আমার হিজাব খুলতে হবে এবং সে সকলের সামনেই এটি পরীক্ষা করে দেখবে। এর পরে সে আরো চারজন কর্মকর্তাকে ডেকে আনে এবং তারাও আমাকে তাদের সামনেই হিজাব খুলে ফেলতে নির্দেশ দেয়।

আমি তখন নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে পারিনি। আমি সেখানে হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলাম।

পরবর্তীতে আমি এবং আমার আইনজীবী যখন আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বাহিরে চলে যাচ্ছিলাম সেখানে দুইজন মহিলা কর্মকর্তা আমাকে জানায় যে, হিজাব খুলে ফেলা ছাড়া আপনি আদালতে প্রবেশ করতে পারবেন না। পরে আমি আমার হিজাব গাড়ির আড়ালে গিয়ে খুলতে চাই যাতে পুরুষ কর্মকর্তারা তা দেখতে না পারে। আমার প্রস্তাবে তারা রাজি হলো।

যখন আমি গাড়ির আড়ালে গিয়ে আমার হিজাব খুলেছিলাম, আমি দেখতে পেয়েছিলাম যে, পুরুষ কর্মকর্তারা দূর থেকে জানালা দিয়ে আমার হিজাব খোলার দৃশ্য অবলোকন করছিলো।

মহিলা কর্মকর্তারা আমাকে আমার হাঁটুর উপর বসাল এবং তারা শুধু মাত্র একটি চুলের ক্লিপ দেখে আমাকে আদালতের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো।

পরে আদালতে প্রবেশ করে আমি তালাকের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করেছিলাম। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমি যেরকম আনন্দ অনুভব করার কথা চিন্তা করেছিলাম তা হয়নি।

এ ঘটনার পরে আমি যখন আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করি তখন আমি এতটাই বিষণ্ণ ছিলাম যে, আমার বাসায় পৌঁছানোর পথ পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম। ফলে বাসায় পৌছাতে আমার প্রায় ৩০ মিনিট দেরি হয়ে যায়।

ঐ দিনের পর থেকে আমি নিজের প্রতি অবিশ্বাস এবং লজ্জা অনুভব করতে থাকি। নিরাপত্তা কর্মীদের সামনে সুরক্ষিত থাকার বদলে আমি অনেকটা ভয়ের মধ্যে থাকি। আমি অনুভব করতে থাকি যে, আমি আমার আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলেছি।

যুক্তরাষ্ট্রের সকল মুসলিম নারীকে প্রত্যেক দিন এরকম আপত্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আমাদেরকে শপিং মল এবং পাবলিক বিল্ডিংগুলোতে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়। আমাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হয়, এমনকি হিজাব পরিধানের কারণে আমরা সহিংসতার মুখোমুখি হই।

যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি দেশ যেখানে সকল ধর্মের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয় সেখানে মুসলিম নারীরা হুমকির সাথে জীবন যাপন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে মুসলিম নারীদেরকে মূল্যায়িত করা হয় না।

আমি হিজাব পরিধান করি আমার বিশ্বাসের জন্য। তথাপি আমি হিজাব খুলতে অস্বীকারও করিনি। আমি শুধু মাত্র আমার ধর্ম এবং আমার বিশ্বাসকে সম্মান করতে কর্মকর্তাদের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, নারী কর্মকর্তাদের সামনে হিজাব খুলতে আমার আপত্তি নেই। এর বদলে আমি ঘৃণার এবং অবমাননার মুখোমুখি হয়েছিলাম।

আমি জানি এই অভিজ্ঞতা আমাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আমাকে জোরপূর্বক হাঁটু গেঁড়ে বসতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সবার সামনে আমার হিজাব খুলে ফেলা হয়েছিল। ওই লজ্জাজনক পরিস্থিতি এবং ভীতিকর অভিজ্ঞতা আমাকে সারা জীবন দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করবে।

অধিকন্তু আমি মনে করি আমার মত পরিস্থিতিতে যাতে আর কোনো মুসলিম নারী না পড়ে সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তুলসা কাউন্টির আদালতের বিরুদ্ধ রুখে দাঁড়াবে। যাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্বিঘ্নে পাবলিক স্থানগুলোতে যাতায়াত করতে পারে।

আমার মত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে যাতে আর কেউ না পড়ে। আমি আশা করবো আমার তরুণ সন্তানদের সামনে যাতে এমন একটা উদাহরণ সৃষ্টি হয়-তারা এমন একটি দেশে বেড়ে উঠছে যেখানে সকল ধর্মকে উপযুক্ত সম্মান দেয়া।

সূত্রঃ হাফিংটন পোস্ট।

মূল প্রতিবেদন পড়তে এখানে ক্লিক করুন