‘কমলার ইসলাম গ্রহণের সময়ে লাভ জিহাদের ধারণাই ছিল না’

প্রকাশিত: ১০:৫৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮

‘কমলার ইসলাম গ্রহণের সময়ে লাভ জিহাদের ধারণাই ছিল না’

কেরালা : ভারতের বিখ্যাত লেখিকা ও কবি কমলা দাসের ইসলাম গ্রহণ ও একজন মুসলিমের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর সময়ে ‘লাভ জিহাদের’ কোনো ধারণাই ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন মালাইলাম চলচ্চিত্র পরিচালক কামাল।

কমলা দাসের বায়োপিক নিয়ে নির্মিত ‘অ্যামি’ চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে উগ্র হিন্দুদের রিট কেরালার হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়ার পর এক সাক্ষাতকারে কামাল এই মন্তব্য করেন।

বায়োপিকটির নির্মাণ ও মুক্তি নিয়ে নানা বিতর্ক ও প্রতিবাদের পর শুক্রবার চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেয়া হয়েছে।

সিনেমাটি ‘লাভ জিহাদ’কে উৎসাহিত করবে-উগ্র হিন্দুদের এমন দাবিতে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।

কামাল বলেন, ‘কমলা দাস যেই সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একজন মুসলিমের প্রেমে পড়েন, সেই সেময়ে ‘লাভ জিহাদের’ কোনো ধারণাই ছিল না। এটি একটি নতুন উদ্ভাবিত শব্দ যা সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলন করা হয়েছে। আমি এখনো জানি না এর অর্থ কী। আমার চলচ্চিত্রের মুক্তির জন্য যথা সময়ে হস্তক্ষেপের জন্য আমি বিচার বিভাগের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করছি।’

তার মতো চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য বিচার বিভাগই একমাত্র সান্ত্বনা বলে তিনি মন্তব্য করেন।

কামাল বলেন, ‘আমাদের মতো মানুষেরা যখন আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, তখন আমরা কোথায় যাব? সঞ্জয় লীলা ভানসালির পদ্মাবত’র মুক্তি নিয়ে কী ঘটনা ঘটনো হয়েছিল, তা দেখুন। আমরা এখনো জানি না, এ নিয়ে বিক্ষোভের কারণগুলো কি ছিল। এই বিক্ষোভ বন্যপ্রাণীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। যাইহোক, চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, বিক্ষোভকারীদের যেসব অভিযোগ ছিল, তার কোনো কিছুই চলচ্চিত্রটিতে নেই।’

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এটা কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা। এমন ভিত্তিহীন বিক্ষোভে জর্জরিত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য এর কোনো প্রতিকার বা সংশোধন আছে কি না আমি জানি না।’

আসছে দিনগুলোতে সৃজনশীল শিল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মনে করছেন।

তিনি বলেন, ‘এসব বিক্ষোভ শুধু সিনেমার বিরুদ্ধেই নয়, সকল শিল্পকর্ম – পেইন্টিং, সাহিত্য, থিয়েটারেরও বিরুদ্ধেও হচ্ছে। তবে, সিনেমা সবচেয়ে বেশি সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে; যা ইতোমধ্যে অনেক বেশি দৃশ্যমান। বই পড়া বা নাটক দেখার চেয়ে মানুষ অনেক বেশি সিনেমা দেখে থাকে। তাই, সিনেমাই হচ্ছে তাদের সহজ লক্ষ্যমাত্রা।’

মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন কেবলই অসাড় তর্জন-গর্জন বলে তিনি মনে করেন।

পরিচালক কামাল

বিখ্যাত লেখক কমলা দাস নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম মাধবীকতি। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর নাম পরিবর্তন করে তিনি নিজের নাম সুরাইয়া রাখেন।

কেরালা হাই কোর্টে চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে পিটিশনের অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, কমলা দাসের জীবনকে বিকৃত করে চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছে। এতে দাবি করা হয়, তার ইসলামের ধর্মান্তর ছিল ‘লাভ জিহাদ’-এর ফল।

আবেদনকারী তার আবেদনে উল্লেখ করেছিলেন যে, পূর্ণ শক্তি ও সমৃদ্ধিসহ তিনি হিন্দুধর্মকে ভারতের মাটিতে দৃঢ়ভাবে দেখতে চান এবং মৌলবাদী শক্তির দ্বারা যখনই কোনো হিন্দুকে অবৈধ, বেআইনি এবং জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটে, তা তাকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করে। তার মতে, কমলা দাসের ইসলামে ধর্মান্তরের মাধ্যমে কেরালায় ‘লাভ জিহাদের শুরু’।

এতে আরো অভিযোগ করা হয়েছিল যে, চলচ্চিত্রের পরিচালক কামাল মৌলবাদী ইসলামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এবং এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ‘লাভ জিহাদ’কে ন্যায্যতা দেয়ার একটি প্রচেষ্টা।

আবেদনকারী দাবী করেন যে, চলচ্চিত্রটিতে সত্যিকারের তথ্য তুলে ধরা হয়নি এবং সুতরাং এটি হিন্দু হিসাবে তার অধিকারকে ‘লঙ্ঘন’ করছে। এতে এও বলা হয়েছিল যে, চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করা হলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে এবং এর ফলে আইন-শৃঙ্খলার ব্যাঘাত হতে পারে।

এছাড়াও, চলচ্চিত্রটি হিন্দু সমাজের মধ্যে ‘ভ্রান্ত ধারণা’র সূচনা করবে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাই, চলচ্চিটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য ভারতের ‘সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন’কে নির্দেশ দেয়ার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছিল।

সম্প্রতি, সুপ্রিম কোর্টে সৃজনশীল চলচিত্র ‘পদ্মাবতী’ মুক্তি নিয়েও অনুরূপ আবেদন করা হলে আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে।

এর আগে, চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য লেখিকা কমলা দাসের চরিত্রের জন্য বিদ্যা বালানকে নির্বাচিত করা হয়েছিল কিন্তু উগ্র হিন্দুদের হুমকির মুখে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন বিদ্যা। পরবর্তীতে বিদ্যার পরিবর্তে জনপ্রিয় মালাই নায়িকা মঞ্জু ওয়ারিয়ারকে মনোনীত করেন পরিচালক কামাল।

কামাল দীর্ঘ দিন যাবৎ কমলা দাসের উপর একটা ছবি বানানোর পরিকল্পনা করে আসছিলেন এবং এজন্য তিনি কমলার কাজ সম্পর্কে পড়াশুনা করেন। তার (কমলার) বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেন। যাতে তিনি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টে তা যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন।

কমলা দাস (১৯৩৪-২০০৯) তার চমৎকার লেখা ও নারীর যৌনতা নিয়ে সরল স্বীকারোক্তির মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেন। ৪২ বছর বয়সে তিনি তার আত্মজীবনী ‘আমার গল্প’ প্রকাশ করেন। যা একটি চমৎকার মালায়ালম গদ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

তিনি তার জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নিজের প্রেমিকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। যদিও তার ভালবাসার সেই মানুষটি সম্পর্কে এখনো কেউ জানে না।

কামাল জানিয়েছিলেন যে, তার ছবিটিতে কিংবদন্তি এই লেখিকার বাস্তব জীবনের গল্প প্রতিফলিত করা হবে।

২০১৬ সালে চলচ্চিত্র উৎসবে থিয়েটারে সিনেমা প্রদর্শনের সময় জাতীয় সংগীত চলাকালে ওঠে না দাড়ানোর অভিযোগে কয়েকজন লোককে গ্রেপ্তার করা হলে কামাল তাদের সমর্থন করে বক্তব্য দেন। তাদের সমর্থন করার জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপির উগ্রপন্থীদের দ্বারা পরে তিনি আক্রমনের শিকার হয়।

ডেইলি টাইমস অবলম্বনে