সরকার প্রশাসনকে দলীয় নেতাকর্মীদের মত ব্যবহার করছে : খালেদা জিয়া

প্রকাশিত: ২:৩১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৮

সরকার প্রশাসনকে দলীয় নেতাকর্মীদের মত ব্যবহার করছে : খালেদা জিয়া

‘নিম্ন আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায়, সঠিক রায় দেওয়ার ক্ষমতা বিচারকদের নেই, নির্বাহী কমিটির সভা বানচাল করতে সরকার নানারকম অপচেষ্টা চালিয়েছে, সরকার প্রশাসনকে দলীয় নেতা কর্মীদের মত ব্যবহার করছে’ বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া।

শনিবার দুপুরে রাজধানীর লা মেরিডিয়েন হোটেলের ১৪ তলার গ্র্যান্ড বল রুমে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। এর আগে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও ধরপাকড় আর বাসায় বাসায় তল্লাশির মধ্যেই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শুরু হয়েছে।

‘সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে’ উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিচারকরা এখন স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারছেন না। ক্ষমতাসীন দল সংবিধানকে নিজেদের মতো করে সংশোধন করে নিয়েছে। সংবিধানে গণতন্ত্রের কিছু রাখা হয়নি। এখন ভোটের অধিকারও কেড়ে নিয়েছে।’

খালেদা জিয়া বলেন, ‘আজকে যারা গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসার দাবি করছে, অস্ত্রের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতায় এসেছে। তত্ত্বাবধায়কের দাবি আওয়ামী লীগের ছিল। এ দাবির জন্য তারা ১৭৩ দিন হরতাল করেছে, জ্বালাও-পোড়াও করেছে। এখন তারা সব মুছে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করছে জনগণকে ভয় পায় বলে।’

‘গুম-খুন-নিত্য ঘটনা। নৌকায় পচন ধরেছে বলে এত আগে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ওয়াদা নিচ্ছেন জনগণের কাছ থেকে’, যোগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

‘দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন নেই’ উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ডিজিটাল আইনের নামে নতুন কালাকানুন করা হচ্ছে মানুষের কণ্ঠরোধের জন্য।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের দুঃশাসন, অত্যাচার, খুন, গুম, জেল-জুলুম থেকে মানুষ মুক্তি চায়। সেজন্য তারা পরিবর্তন চাইছে। এটা অন্য কোনো পথে নয়, জনগণের ভোটের মাধ্যমে হতে হবে।’

খালেদা জিয়া স্পষ্ট ভাষায় জানান, তার দল বিএনপি শত জুলুম-নির্যাতনের মধ্যেও এক এবং ঐক্যবদ্ধ আছে।

এ সময় দলের নেতারা ‘আমাদের নেত্রী আমাদের মা। জেলে যেতে দেব না; বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় উদ্বোধনী বক্তব্যে খালেদা জিয়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ছয়টি শর্ত দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া শর্তগুলো হলো:
* ভোট হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে

* জনগণকে ভোটকেন্দ্রে আসার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে

* ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে

* নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে

* ভোটের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে, সেনাবাহিনী মোবাইল ফোর্স হিসেবে কাজ করবে

* যন্ত্রে ভোটের জন্য ইভিএম/ডিভিএম ব্যবহার করা যাবে না

খালেদা জিয়া বলেন, আমি যেখানেই থাকি না কেন আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে লাভ নেই। দলের নেতা ও এ দেশের মানুষের সঙ্গে আছি। তিনি দলের নেতাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ-প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ঐক্যবদ্ধ থাকতে নেতা কর্মীদের পরামর্শ দেন।

সভায় ছয় শর্ত দেওয়ার পর খালেদা জিয়া নির্বাহী কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চান তারা এর সঙ্গে একমত কি না। এ সময় নির্বাহী কমিটির সদস্যরা উচ্চ স্বরে বলেন একমত।

সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের প্রয়োজনে এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। তিনি দলের নেতাদের বলেন, একবার ক্ষমা করেছি। কিন্তু ক্ষমা বারবার করা যায় না। তাই দল ভাঙার যত চেষ্টাই হোক কেউ ফাঁদে পা দেবেন না। যারা দলের প্রতি অনুগত থাকবেন তাদের মূল্যায়ন করা হবে। যারা থাকবেন না তাদের আর ক্ষমা করা হবে না।

এর আগে শনিবার সকাল ১১ টার দিকে এই সভা শুরু হয়েছে। সারা দেশের বিএনপির নেতারা যোগ দিয়েছেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির এই বহুল আলোচিত সভায়। অনেকে গ্রেপ্তার এড়াতে বিমানে করে ঢাকায় এসেছেন।

পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সভাটি শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করছেন দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সঞ্চালনা করছেন প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। ওলামা দলের আহ্বায়ক হাফেজ মাওলানা শাহ মোহাম্মদ নেসারুল হকের কোরআন তেলাওয়াত করেন। এরপর দোয়া মোনাজাত করা হয়।

এদিকে, লা মেরিডিয়ানের চারপাশে বিপুলসংখ্যক আইনশৃংখলাবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত আছেন। এমনকী হোটেলের ভেতরে সাদা পোশাকের সদস্যরাও উপস্থিত রয়েছেন। গোয়েন্দাসংস্থার একটি সূত্র জানায়, কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা নির্বাহী বৈঠকটিকে ফলো করছেন।

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের আগে আজকের এই সভা থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর আগে বিএনপির চেয়ারপারসন জরুরিভাবে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে আগামী দিনের জন্য কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি।

এব্যাপারে দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আভাস পাওয়া গেছে, তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়েই পরবর্তী সময়ের কর্মসূচি দিতে চান বিএনপির চেয়ারপারসন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভার আমন্ত্রিত সদস্যদের পরিচয়পত্র গত বৃহস্পতিবার থেকেই বিতরণ করা হচ্ছে। সভায় কেন্দ্রীয়, জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ প্রায় সাতশ নেতাকর্মীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের ৭০০ নেতা উপস্থিত আছেন। এর মধ্যে নির্বাহী কমিটির সদস্য ৫০২ জন। স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলার সভাপতিরা অংশ নিচ্ছেন বৈঠকে। নির্বাহী বৈঠকের দুটি অধিবেশন হবে। প্রথমটি উন্মুক্ত, দ্বিতীয় অধিবেশনটি সাংগঠনিক।

এব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, নির্বাহী কমিটির ৫০২ জন সদস্যের মধ্যে এরই মধ্যে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। কয়েকজন অসুস্থ আছেন। বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে তারা সভায় যোগ দিতে এসেছেন।

সভায় আলোচনার বিষয় সম্পর্কে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দেখুন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিনিয়ত দুর্বল হচ্ছে। গণতন্ত্র দুর্বল হওয়া মানে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অরক্ষিত হওয়া। সরকার গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিচ্ছে। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কোনো কল্যাণকর কাজ নয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপি নেতাদের রাস্তায় দাঁড়াতে দিচ্ছে না। কিন্তু সরকার দলের লোকজন রাস্তা আটকে প্রতিদিন সভা করছে। এটার আমরা পরিবর্তন চাই। আমাদের অনেক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, তাদের নিয়ে কোথায় রাখা হচ্ছে সেটাও জানা যাচ্ছে না। এটাই পরিবর্তন হওয়া জরুরি। সব দিক বিবেচনায় নিয়েই আজকেই এই সভা। সেই অনুযায়ী দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বক্তব্য দেবেন, দিকনির্দেশনা দেবেন।’

শনিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৮টার পর থেকেই নেতারা হোটেলে আসতে শুরু করেন। এর মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের নেতারা রয়েছেন। হোটেল চত্বরে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা অনেককে নাম নিবন্ধন করে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।