নানা ঘটনায় বছর শেষে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গন

প্রকাশিত: ২:৫০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১, ২০১৮

নানা ঘটনায় বছর শেষে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গন

২০১৭ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কিছু আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা ছিল, যেগুলো বেশ প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। এর মধ্যে-

জানুয়ারি
৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ‘গণতন্ত্র হত্যা্ দিবস’ উপলক্ষে ‘কালো পতাকা মিছিলের’ কর্মসূচি দেয় বিএনপি। তবে সমাবেশের অনুমতি না পেয়ে সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক দেয় দলটি।বছরের শুরুতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে রাজনীতির মাঠে, দেশজুড়ে সংঘাতের শংকা দেখা দেয়।

ফেব্রুয়ারি
ফেব্রুয়ারিতে নতুন নির্বাচন কমিশন ঘোষণা হলে তাতে আপত্তি জানায় বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের মিত্ররা। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিবর্তে ‘প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে’ বলে অভিযোগ আনা হয় জোটের পক্ষ থেকে।

১৫ ফেব্রুয়ারি ১২তম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার কমিশনারসহ পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পান। এর আগে এ পদে আরো ১১ জন দায়িত্ব পালন করেছেন। সব কিছু ঠিক থাকলে তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনেই আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

১৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে যমুনা রিসোর্টে এক এমপিকে উপস্থিত না পেয়ে ওবায়দুল কাদের আরেক সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেনকে চড়-থাপ্পড় মারেন।

মার্চ
২০ মার্চ-২০১৭ (২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস) পালনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের পর ২১ মার্চ ২০১৭ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পরিপত্র জারির মাধ্যমে শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে ২৫ মার্চ তারিখকে গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

মার্চে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বিজয়ী হন। এই জয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়ে বিএনপির। ওই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সাক্কু পান ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা পান ৫৭ হাজার ৭৬৩ ভোট।

এপ্রিল
৭-১০ এপ্রিল ভারত সফর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে এটাই ছিল শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর।

১৯ এপ্রিল ঢাকা মহানগরে নতুন নেতৃত্ব আনেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথমবারের মতো সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে মিল রেখে ঢাকা মহানগরে উত্তর-দক্ষিণ নামে দুটি কমিটি করা হয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি করা হয় আগের কমিটির সদস্যসচিব এবং বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলকে। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান আগের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী আবুল বাশার। আর ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় আবদুল কাইয়ুমকে এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান আহসান উল্লাহ। তবে এই কমিটি এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি।

মে
১০ মে বিএনপির ভিশন-২০৩০ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন খালেদা জিয়া। তার এই ভিশন রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত হয়। এতে প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে দাবি করে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যামে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা। ৩৭টি বিষয়ের ওপর ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনার কথা জানান বিএনপি প্রধান।

২০ মে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে তল্লাশি চালায় পুলিশ। ‘রাষ্ট্রবিরোধী ও আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী নাশকতা সামগ্রীর খোঁজে’ এ অভিযান চালানো হয় বলে তখন পুলিশ দাবি করে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, অভিযানের সময় পুরো কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র তছনছ করে দেওয়া হয়। পুলিশ অনুমতি ছাড়াই কার্যালয়ে প্রধান ফটকের গেটের তালা ভেঙে কার্যালয়ে প্রবেশ করে। অফিসের ভেতরে থাকা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি টিভি) ভেঙে ফেলা হয়।

জুন
৮ জুন সৌদি আরব সফর শেষ করে দেশে ফিরছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সফরসঙ্গীরা। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার মুহূর্তে রানওয়েতে ধাতব বস্তু দেখতে পান পাইলট। রানওয়েতে না নেমে প্রায় ২০ মিনিট বিমানটি আকাশে উড়তে থাকে। এ ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়।

জুলাই
৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সেই রায় বহাল রেখে রায় প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। রায়ে একক নেতৃত্বের সমালোচনা করায় বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে আওয়ামী লীগ। শুরু হয় রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে আদালতপাড়াসহ সারা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে ওঠে।

৩১ জুলাই সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংলাপ শুরু করে কমিশন। গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা, নারী নেত্রীদের প্রতিনিধি ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এ সংলাপ চলে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত।

মধ্য জুলাইয়ে লন্ডন যান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেখানে আগে থেকে অবস্থানরত বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় ওঠেন তিনি। লন্ডনে থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বক্তব্য দেন সরকারি দলের নেতারা। এর মধ্যে দুটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তার দেশে ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা কথাবার্তা শুরু হয়।

আগস্ট
১ আগস্ট ২০১৭ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত হাই কোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এ রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দেন। পরবর্তীতে ১ আগস্ট ২০১৭ প্রকাশিত হয় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়। আর এর মাধ্যমেই পুনর্বহাল হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

৮ আগস্ট পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে রফিকুল ইসলাম শাকিল ও পলাতক রাজন তালুকদারের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। পাঁচ বছর আগের আলোচিত এ মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দুজনকে খালাস দেওয়া হয়। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দুজন আপিল করেছিল, তারা হাইকোর্টে খালাস পায়। পলাতক থাকা বাকি ১১ জনের বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ফলে তাদের ক্ষেত্রে আগের সাজাই বহাল থাকে। বিশ্বজিৎ দাসের পরিবার এ রায়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে।

সেপ্টেম্বর
১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের দেখতে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগস্টের শেষভাগে মায়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ঘিরেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খানিকটা ব্যস্ততা দেখা যায়।

অক্টোবর
২ অক্টোবর এক মাস ছুটির কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি পাঠান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে জানানো হয়।

৭ অক্টোবর রাজনৈতিক বড় শো-ডাউনের মাধ্যমে অক্টোবরে নিজেদের অবস্থানও জানান দেয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদান শেষে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফেরার দিন । ওইদিন দলের নেতাকর্মীরা রাজধানীতে ব্যাপক শো-ডাউন করে।

১৫ অক্টোবর দলের ২০ দফা প্রস্তাব নিয়ে সংলাপে যোগ দেয় বিএনপি। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ১১ দফা প্রস্তাব নিয়ে অংশ নেয় ১৮ অক্টোবর। তবে প্রধান দু’দলের মূল প্রস্তাব ছিলো পরস্পর বিরোধী। বিশেষ করে সেনা মোতায়ন, সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন ও ইভিএম ব্যবহার নিয়ে তাদের অবস্থান বিপরীতমুখী। নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দল ।

১৫ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে সংলাপে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলায় আরেকবার আলোচনায় আসেন সিইসি। সেদিন সংলাপে জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করে নূরুল হুদা বলেন, ‘বহুমত, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন।

১৬ অক্টোবর সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলায় সিইসি কে এম নুরুল হুদার পদত্যাগ দাবি করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী

১৮ অক্টোবর তিন মাস লন্ডনে চিকিৎসা শেষে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এদিন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দর থেকে গুলশানে যাওয়ার পথে পথে সমবেত হন এবং রাজপথে মানবপ্রাচীর তৈরি করে নেতাকর্মীরা । এ ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচিত হয়। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও প্রাণের সঞ্চার করে এই এই শো ডাউন।

২৮ অক্টোবর উখিয়ার উদ্দেশে ঢাকা থেকে রওনা দেন তিনি। এর মধ্যে কুমিল্লাতে বহরে থাকা বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সাংবাদিকরা আহত হন। মাঝে চট্টগ্রামে যাত্রাবিরতি দিয়ে ৩০ অক্টোবর কক্সবাজারের উখিয়া পৌঁছান বিএনপি নেত্রী। উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিয়ে ফেরার পথেও গাড়িবহরে হামলা হয়। ওই সময়ে রাস্তায় দাঁড়ানো দুটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

নভেম্বর
১০ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন ছুটিতে থাকা এস কে সিনহা। ১২ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন।

১২ নভেম্বর দীর্ঘ প্রায় দুই বছর পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করে বিএনপি। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় নেতাকর্মীদের ব্যাপক শো-ডাউন করতে দেখা যায় সেদিন। শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় বিএনপির নেতাকর্মীরা।

১৭ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো ঘটে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের ত্রুটির ঘটনা। হাঙ্গেরি সফরে যাওয়ার পথে শেখ হাসিনাকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং-৭৭৭ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাতে অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি করে। ত্রুটিগুলো দুর্ঘটনা নাকি ইচ্ছাকৃত ছিল এনিয়ে দেশে ও বিদেশে আলোচনার শীর্ষে ছিল।

১৮ নভেম্বর নাগরিক সমাবেশ আওয়ামী লীগ। নভেম্বরে দু’দফা সমাবেশ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ৭ মার্চের ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতি উদযাপনে ১৮ নভেম্বর নাগরিক সমাবেশ ও ২৫ নভেম্বর দলের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

১৯ নভেম্বর চলতি বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে, সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। এ সময় নিজেরা কুশল বিনিময় করেন। বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়।

৩০ নভেম্বর পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশে তিন দিনের সফর করেন। বিশ্বের যে কোনো দেশে পোপের সফরকে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন বিবেচনা করা হয়। চলতি বছরসহ গত তিন বছরের মধ্যে তার তিনটি দেশ সফরের তালিকার একটি ছিল বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

ডিসেম্বর
৪ ডিসেম্বর রাজনীতিতে নতুন চমক দেয়ার চেষ্টা করে বিকল্পধারা প্রধান সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে নতুন জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’। দীর্ঘ সলা-পরামর্শের পর একাদশ সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে বিকল্পধারা, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সমন্বয়ে এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

৭ ডিসেম্বর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরবে বিএনপি নেত্রীর সম্পদের খবর নিয়ে কথা বলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানান বিএনপি মহাসচিব। প্রধানমন্ত্রীকে ‘ক্ষমা প্রার্থনার’ আহ্বান রেখে তিনি সেদিন বলেছিলেন অন্যায় তারা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উকিল নোটিশ পাঠান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নোটিশ পাঠানোর ৩০ দিনের মধ্যে ‘নিঃশর্ত ক্ষমা না চাইলে’ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ আদায়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে নোটিশে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ১৯ ডিসেম্বর রেজিস্টার্ড ডাকযোগে এবং কুরিয়ার সার্ভিস মাধ্যমে এই উকিল নোটিশটি পাঠান, যা ২০ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও চ্যালেঞ্জের মুখে ছিলেন সিইসিসহ বর্তমান কমিশন। এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়র প্রার্থী হন। নির্বাচনে আসে বিএনপিও এবং কাওছার জামান বাবলাকে প্রার্থী করে। এদিকে জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে কথিত রংপুরে দল থেকে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে প্রার্থী করা হয়। নির্বাচনে মোট ১৯৩টি কেন্দ্রে লাঙল প্রতীকে এক লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে বিজয় পান জাপার মোস্তফা।

২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়ার উকিল নোটিশ পাঠানোর বিষয়ে বিবিসির এক সংবাদের কিছু অংশের প্রতিবাদ জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা জাহিদ এফ সরদার সাদী এবং ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা আবু সায়েম দুটি পৃথক বিবৃতিতে । গত ২০ শে ডিসেম্বর বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকটা অভিন্ন ভাষায় বিবৃতিতে বলা হয়েছিল ‘সৌদি আরবে বিপুল সম্পদ পাচারের ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পরিবারের নাম উঠে আসার খবর সম্প্রতি বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।’ যা সত্য নয়।

২৩ ডিসেম্বর চারমাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর বিকেলে তাকে চারদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।

২৪ ডিসেম্বর বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্য মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, আগামী দিনে যে কর্মসূচি দেয়া হবে সেই কর্মসূচি পালনে আন্দোলন সংগ্রাম ও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হাসিনাকে ক্ষমতায় এবং অনির্বাচিত সংসদ বহাল রেখে দেশে কোন নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচন হবে না।

৩১ ডিসেম্বর প্রায় চার মাসেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ থাকা বিএনপির নেতা ও ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদকে ‘গ্রেপ্তার’ করে পুলিশ। এব্যাপারে পুলিশ বলেছে, সাদাত আহমেদ ২০১৫ সালে করা একটি মামলার আসামি, সে কারণে তাকে ‘গ্রেপ্তার’ করা হয়েছে এবং তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তবে সাদাত আহমেদের স্ত্রী লুনা সাদাত আহমেদ দাবী করেছেন তার স্বামীর বিরুদ্ধে কোন মামলা ছিল না।

এছাড়া বছরজুড়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজিরা দিতে হয় দেশের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত ঘটনা। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসে টানা কয়েকদিন হাজিরাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গণ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এই ঘটনা হয়রানিমূলক বলে নানারকম আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এব্যাপারে বিএনপি নেতারা বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে ৭৮ হাজার ৩২৩ মামলায় আসামির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৩ হাজার ২৩৮, ‘গুম-খুন’র পরে মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা।

এছাড়া ২৯ সংসদ সদস্যের চিরবিদায়ের বছর-২০১৭ সাল
চলতি বছরে তিনজন ও সাবেক ২৬ জনসহ মোট ২৯ এমপি জাতীয় সংসদ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এমপি মারা গেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। তাদের সাবেক, বর্তমান মিলে মোট ১৩ সংসদ সদস্য মারা গেছেন। আর দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির ১১ এমপি মারা গেছেন। এদের মধ্যে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতিও রয়েছেন। এছাড়া জাতীয় পার্টির চারজন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের একজন সাবেক সংসদ সদস্য মারা যান।

৫ ফেব্রুয়ারি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা যান চলতি বছরের। সাবেক রেলমন্ত্রী এবং আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৫ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।

১৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক ৭৫ বছর বয়সে মারা যান।

১৯ ডিসেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের এমপি গোলাম মোস্তফা আহমেদ টাঙ্গাইলে সড়ক দুর্ঘটনা আহত হওয়ার পর প্রায় একমাস চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান।

আওয়ামী লীগের যারা মারা গেছেন : চলতি বছরে সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় এ তিনজন ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ (যশোর-২), সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) এ এ মারুফ সাকলান (নীলফামারী-৪), মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ (ময়মনসিংহ-৭), তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ এবং সাবেক এমপি ইসহাক মিঞা (চট্টগ্রাম-১০), খান টিপু সুলতান (যশোর-৫), সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ এবং সাবেক এমপি নারারণগঞ্জ জেলার ডা. মো. সাদত আলী সিকদার, অধ্যক্ষ এস এম আবু সাঈদ (নড়াইল-১), তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও সাবেক এমপি সরদার মোশারফ হোসেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার শফিকুল ইসলাম খোকা (জামালপুর-৩) ও মো. মর্তুজা হোসেন মোল্লা (কুমিল্লা-২) মারা যান।

বিএনপির যারা মারা গেছেন : বিদায়ী বছরে বিএনপির সাবেক সংস্থাপন ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী নূরুল হুদা (চাঁদপুর-২), কাজী মো. আনোয়ার হোসেন (ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া-১), ধীরেন্দ্র নাথ সাহা (নড়াইল-১), কে এম আবদুল খালেক চন্টু (কুষ্টিয়া-৩), এহসান আলী খান (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩), সাবেক মন্ত্রী হারুনার রশিদ খান মুন্নু (মানিকগঞ্জ-২ ও ৩), হাজী মো. মোজাম্মেল হক (চুয়াডাঙ্গা-২), ডা. মো. ছানাউল্লা (ঢাকা-২২), সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংদের স্পিকার আবদুর রহমান বিশ্বাস (বরিশাল-৫), প্রাদেশিক পরিষদ এবং সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার (হোমনা, কুমিল্লা) ও জয়নুল আবেদীন সরকার (লালমনিরহাট-১) মারা যান।

জাতীয় পার্টি : অন্যদিকে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি জাফরুল হাসান ফরহাদ (বরগুনা সদর বেতাগী), আহসান আহমদ (নীলফামারী-২), মো বদরুজ্জামান (কুষ্টিয়া-৩) ও মোফাজ্জল হোসেন (রংপুর-৩) মারা যান।

আর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের টাঙ্গাইলের (গোপালপুর-ভূঁয়াপুর) সাবেক আবদুল মতিন মিয়াকেও এ বছর হারায় জাতীয় সংসদ।