১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:২৭ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ২১, ২০১৭
নিউইয়র্ক: বাংলাদেশের সবচেয়ে নামকরা ফটো সাংবাদিকদের একজন জুয়েল সামাদ তার সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে বহু দুঃসাহসিক এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। ইরাক রণাঙ্গন থেকে প্রেসিডেন্ট ওবামার হোয়াইট হাউস, এশিয়ান সুনামি থেকে রিও অলিম্পিক- বহু বিচিত্র বিষয় কভার করেছেন। বিবিসি বাংলার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি বর্ণনা করেছেন তার সেসব অভিজ্ঞতা।
এয়ার ফোর্স ওয়ানঃ
লস এঞ্জেলেস থেকে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে আকাশে উড়েছে এয়ার ফোর্স ওয়ান। পাঁচ ঘন্টার ফ্লাইট। লস এঞ্জেলেসে একটি ব্যস্ত দিন কেটেছে সবার। সেখানে প্রেসিডেন্ট ওবামা ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন এক অনুষ্ঠানে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে নানা বিষয়ে প্রতিদিন চিঠি লেখেন অনেক মানুষ। নির্বাচিত কিছু পত্রলেখককে প্রেসিডেন্ট লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন স্থানীয় এক রেস্টুরেন্টে। ছিল আরও নানা আনুষ্ঠানিকতা।
ফিরতি যাত্রায় এয়ারফোর্স ওয়ানের প্রেস কেবিনে সফরসঙ্গী সাংবাদিকরাও কিছুটা ক্লান্ত। নানা কাজে ব্যস্ত কেউ কেউ। হঠাৎ কেবিনের দরোজা দিয়ে ঢুকলেন প্রেসিডেন্ট। এএফপির ফটো সাংবাদিক জুয়েল সামাদের জন্য সেটাই ছিল এয়ার ফোর্স ওয়ানের শেষ ফ্লাইট। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সর্বশেষ সফর।
‘যেভাবে তিনি আমাকে বিদায় জানাতে আসলেন প্রেস কেবিনে, দ্যাট ওয়াজ ভেরি নাইস। আমি কিছুটা আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। উনি আমার সঙ্গে বেশ রসিকতাই করলেন। বললেন, নিউইয়র্কে কেন যাচ্ছো। ওখানে তো বাড়ি ভাড়া অনেক বেশি।’
হোয়াইট হাউস প্রেস কোরের সদস্য হিসেবে প্রায় সাড়ে ছয় বছর ধরে বিশ্বের বহু জায়গায় প্রেসিডেন্ট ওবামার সফর-সঙ্গী ছিলেন জুয়েল সামাদ। ছিলেন বহু ঐতিহাসিক মূহুর্তের সাক্ষী। তবে এর মধ্যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অনেক মধুর অন্তরঙ্গ মূহুর্তের স্মৃতিও আছে। এটি ছিল সেরকম একটা দিন।
হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের ট্রাভেল পুলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারাটা যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা সাংবাদিকদের জন্যও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো ব্যাপার। সাংবাদিকরা যখন খ্যাতির শিখরে পৌঁছান, তখন সাধারণত ‘প্রাইজড পোস্টিং’ হিসেবে হোয়াইট হাউজে পাঠানো হয়। জুয়েল সামাদের জন্য সেখানে কাজ করার সুযোগটা এসে গিয়েছিল বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে।
বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরের ঘটনা সেটি।
‘তখন আমার পোস্টিং ইন্দোনেশিয়াতে। আমাদের এএফপি’র নর্থ আমেরিকার ডিরেক্টর, উনি আমাকে হোয়াইট হাউজে নিয়ে আসেন। উনি চাইছিলেন হোয়াইট হাউজ একটু ভিন্নভাবে কভার করতে। একজন ফ্রেশ, ইয়াং কোন ফটোগ্রাফারকে দিয়ে। আমেরিকার সঙ্গে রিলেটেড নয় এমন কাউকে দিয়ে। আমাকে উনি ওয়াশিংটনে নিয়ে আসলেন। প্রায় সাড়ে ছয় বছর আমি ওবামা এডমিনিস্ট্রেশন কাভার করেছি।’
বারাক ওবামা ছিলেন হোয়াইট হাউসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। আর জুয়েল সামাদ তার প্রেস কোরে ঠাঁই পাওয়া প্রথম কোন বাংলাদেশি সাংবাদিক।
এপি, এএফপি, রয়টার্স এবং নিউইয়র্ক টাইমস, শুধু এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সার্বক্ষণিক ফটোসাংবাদিক থাকেন হোয়াইট হাউসে। এরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের ট্রাভেল পুলের অংশ। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট যেখানেই যাবে, তার সঙ্গে থাকবেন এই চারজন। এরকম একটা বিরল সুযোগ পেয়ে জুয়েল সামাদ ছিলেন তার ভাষায় ‘সুপার একসাইটেড’।
‘আমি কখনো ভাবিনি যে একদিন হোয়াইট হাউজ কভার করার সুযোগ আসবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ট্রাভেল করে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ হবে। প্রেসিডেন্টকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাবো এবং ট্রাভেল করতে পারবো। সত্যি কথা বলতে কি, এটা একটা প্রিভিলেজ। আমি যে সাড়ে ছয় বছর এই কাজটা করতে পেরেছি, সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ।’
ক্যামেরা হাতে কিশোর:
তবে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত জুয়েল সামাদের এই জার্নিটা খুব সহজ ছিল না।
নব্বুই এর দশকের শুরুতে ঢাকা শহরে ঝাঁক বেঁধে নানা জায়গায় ছুটে যেতে ফটো সাংবাদিকদের যে দল, তাদের মধ্যে ছিল ১৫ বছরের এক কিশোর। কিছুটা নেশায়, কিছুটা জীবিকার তাগিদে তাকে পথে নামতে হয়েছিল।
‘আমার বাবা, দুই চাচা ছিলেন এই পেশায়। এটা যেন আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর কিছু একটা করতে চাচ্ছিলাম আমার এডুকেশন সাপোর্ট করার জন্য। অন্য কিছু আর মাথায় আসেনি ফটোগ্রাফি ছাড়া। তখন আমার বয়স মাত্র ১৫ বছর।’
কাজ শুরু করেছিলেন ঢাকার মর্ণিং সান পত্রিকায়। কিছুদিন পর যোগ দেন দৈনিক জনকন্ঠে। সেখানে কাজ করেছেন পাঁচ বছরের বেশি।
‘যে বয়সটা খেলাধুলার, সেই বয়সে আমি ঢুকে গেলাম কাজে। এক অর্থে এটা ছিল আমার জন্য ভালো সুযোগ। আবার অন্যদিকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই চ্যালেঞ্জিং।’
বড় বড় ফটো সাংবাদিকদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পেতে অনেক সময় লেগেছে। টিটকারি শুনতে হয়েছে কাজ করতে গিয়ে।
‘হাতে গোণা দু একজন লোক ছাড়া শেখানোর লোক খুব কম ছিল। উল্টো বাধা দেয়ার লোক অনেক ছিল। রাস্তায় যখন ছবি তুলতে যেতাম, তখন নানা কথা শুনতে হতো, বলতো, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সাংবাদিক বনে গেছে।’
কিন্তু সেসব তিনি গায়ে মাখেন নি।
আজকের সাফল্যের পর পেছন ফিরে দেখলে কি মনে হয়?
‘আমার জন্য দরকার ছিল এই স্ট্রাগলটা। আমার জন্য এটা ফাউন্ডেশন হিসেবে কাজ করেছে। এখান থেকে আমি যা শিখেছি, তা আমাকে সবসময় সাহায্য করেছে।’
২০০০ সালে ক্যারিয়ারে প্রথম বড় সুযোগ পান এএফপির ঢাকা অফিসে যোগ দেয়ার মাধ্যমে।
‘এএফপিতে যোগ দেয়ার পর বুঝতে পারি যে ফটো জার্নালিজম মানে বাংলাদেশের গন্ডিতে আটকে থাকা নয়। সারা বিশ্বে কাজ করার সুযোগ আছে। তখন থেকেই আমার ইচ্ছে হয়, আরও অনেক ধরণের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করার। এবং এএফপিতে জয়েন করার পর আমি সুযোগগুলো পাই।’
যুদ্ধ দিনের গল্প:
২০০১ সালে ভারতের গুজরাটের ভূমিকম্প ছিল জুয়েল সামাদের প্রথম ফরেন অ্যাসাইনমেন্ট। এরপর থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বা অন্যান্য অঞ্চলে যত বড় বড় ঘটনা ঘটেছে, তার সবগুলো কভার করার সুযোগ হয়েছে। আফগান এবং ইরাক যুদ্ধের সময় এএফপির হয়ে সেখানে গেছেন।
‘আফগান এবং ইরাক যুদ্ধ আমার ক্যারিয়ারের বড় দুটি ঘটনা। এই দুটি যুদ্ধ আমাকে তৈরি করেছে। আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর সেখানে পাঠানো হয় আামাকে। আমি ছিলাম পাকিস্তান-আফগানিস্তান বর্ডারে। যখন তালেবানের পতন হয়, তখন কাবুলে যাই। ভয়ের চেয়ে উত্তেজনাটাই বেশি কাজ করছিল এরকম একটা সুযোগ পেয়ে।’
‘আফগানিস্তানে একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে। আমি এবং আমার এক অস্ট্রেলিয়ান কলিগ কাজ করছিলাম। আমেরিকান বি-ফিফটি-টু বিমান থেকে বোমা ফেলা হচ্ছিল পাহাড়ে। রাস্তার ধারে থেমে আমরা ছবি পাঠাচ্ছিলাম। হঠাৎ পেছনে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। পেছনের গাড়িতে টরোন্টো স্টারের একজন সাংবাদিক এবং ফটো সাংবাদিক ছিল। তারা আসলে স্বামী-স্ত্রী। মহিলা সাংবাদিকের একটা পা গ্রেনেড হামলায় উড়ে গেছে।’
ঐ আহত সাংবাদিককে পরে জুয়েল সামাদ এবং তার সহকর্মীই নিজেদের গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানকার লোকজন বললো, এখানে চিকিৎসা করা যাবে না। পরে তারা আবার গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যান নিকটবর্তী মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে। সেখান থেকে কাবুলে এয়ার-লিফট করা হয় তাকে। ঐ মহিলা সাংবাদিকের জীবন বাঁচাতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তারা।
মোট পাঁচ দফায় ইরাক যুদ্ধ কভার করেছেন জুয়েল সামাদ। সেখানেও ছিল অনেক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।
‘যে পাঁচ বার ইরাক যুদ্ধ কভার করতে যাই তার মধ্যে তিনবারই মার্কিন বাহিনির সঙ্গে ‘এমবেডেড’ হয়ে। দুবার বাগদাদে স্বাধীনভাবে।’
টিকরিটে যে মার্কিন সেনাদল সাদ্দাম হোসেনকে তার গোপন সুড়ঙ্গ থেকে আটক করে, জুয়েল সামাদ ছিলেন সেই সেনাদলের সঙ্গে এমবেডেড।
‘ওরা বিভিন্ন রেইডে যাওয়ার সময় আমাদের সাথে নিয়ে যেত। কিন্তু যেদিনের অভিযানে সাদ্দাম হোসেন ধরা পড়ে, সেদিন আমাদের নেয়নি। পরের দিন আমাদের সেখানে নিয়ে যায় মার্কিন সেনাবাহিনি। সাদ্দাম হোসেন বাংকার টাইপের ছোট্ট একটা গর্তে লুকিয়ে থাকতেন। আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।’
সেনাবাহিনির সঙ্গে ‘এমবেডেড’ হয়ে কাজ করার সময় কয়েকবার হামলারও শিকার হয়েছেন।
‘টিকরিটে একবার আমাদের কনভয়ের একটি গাড়িতে আইইডি হামলা হয়। আমি ছিলাম তিন গাড়ি পেছনে। আরেকবার আমাদের কনভয়ের ওপর গুলি চলে। তবে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।’
তবে এত অভিজ্ঞতার মাঝে হোয়াইট হাউসের সাড়ে ছয় বছরের জীবনকেই তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময় বলে মনে করেন জুয়েল সামাদ।
প্রতিদিন প্রেসিডেন্ট কোথায় যাচ্ছেন, কী কর্মসূচি, তার বিস্তারিত আমরা আগের রাতেই জানতে পারতাম। সেই অনুযায়ী তারা কাজের পরিকল্পনা করতাম। প্রেসিডেন্টের পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স কি আছে, কোথায় ছবি তোলা যাবে, কোথায় যাবে না, এসব আগে থেকে জানানো হতো আমাদের।’
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে যেদিন, সেদিন জুয়েল সামাদের দায়িত্ব পড়েছিল নিউইয়র্কে হিলারি ক্লিনন্টনের সমাবেশ কভার করার।
হিলারি ক্লিনটনের জন্য স্টেজটি সাজানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মানচিত্রের আদলে। হিলারি জিতবেন, এমনটাই সবাই প্রত্যাশা করছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হবেন তিনি, তার একটি ‘আইকনিক’ ছবি তোলার জন্য দুদিন ধরে ক্যামেরা সেট করলেন তিনি।
কিন্তু ফল যখন ঘোষণা করা হলো, সব পরিকল্পনা পাল্টে গেল!
‘যদি হিলারি জিততো, তাহলে হয়তো এটি একটি আইকনিক ছবি হতে পারতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাপের মাঝখানে হিলারি দাঁড়িয়ে তার বিজয়ের পর বক্তৃতা দিচ্ছেন, এরকম একটা ছবি।’
তবে তাই বলে খেদ নেই জুয়েল সামাদের। বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা একটি সংস্থার আর্কাইভে তার ছবি আছে প্রায় ৯০ হাজার। এএফপির হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন ফটোগ্রাফারেরই এত বেশি ছবি তাদের আর্কাইভে রাখা হয়েছে।
জুয়েল সামাদ এখন এএফপির নিউইয়র্ক ব্যুরোতে কাজ করেন। কিন্তু তারপরও বিশ্বের যেখানেই বড় কোন ঘটনা ঘটে, সেখানে পাঠানো হয় তাকে।
জুয়েল সামাদের স্ত্রী গোধুলি খানও ফটো সাংবাদিক। দুই কন্যা নিয়ে নিউইয়র্কে তাদের সংসার।
তার স্বপ্ন, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ফটো সাংবাদিকদের জন্য কিছু করা।
‘যদি সম্ভব হয় বাংলাদেশের ফটো সাংবাদিকদের জন্য কিছু করতে চাই্। তারা অনেকেই বেশ ভালো করছেন। অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাচ্ছেন। আমার কাজের অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।
EDITOR & PUBLISHER :
DR. ARIF AHMED MOMTAZ RIFA
MOBILE : 01715110022
PHONE : 0821 716229
Office : Central Market (1st floor),
Bandar Bazar (Court Point),
Sylhet – 3100, Bangladesh.
E-mail : sylhetsangbad24@gmail.com
Hello : 01710-809595
Design and developed by M-W-D