রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা বিশ্ব সোচ্চার হলেও সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে : ফখরুল

প্রকাশিত: ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৭

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা বিশ্ব সোচ্চার হলেও সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে : ফখরুল

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমস্যা সমাধানের কথা বলতে হবে, আলোচনা করতে হবে। অথচ এ ব্যাপারে সরকারের মনোভাব আমরা ঠিক বুঝতে পারি না। মূলত পুরোপুরি নতজানু হয়ে গেলে, নিজস্বতা না থাকলে এবং অন্যের উপর নির্ভর করে চলতে থাকলে সাধারণত এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়। আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানাচ্ছি, রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের এই গণহত্যার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই এবং মিয়ানমার সরকারকে বলছি অবিলম্বে তারা যেন রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা বন্ধ করে। গতকাল মঙ্গলবার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১০ম কারামুক্তি দিবস উপলে আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। এ আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয়তাবাদী যুবদল। : মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি নয় বরং আওয়ামী লীগ রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাজনীতি করতে চায় বলেই এখন তারা প্রস্তাব দিচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর বাংলাদেশের বিজিবি যৌথভাবে টহল দিয়ে অভিযান চালাবে। কিন্তু কোথায় এবং কার বিরুদ্ধে এ অভিযান চালানো হবে। যাদেরকে হত্যা, ধর্ষণ করা হচ্ছে, যাদের শিশুদের মেরে ফেলা হচ্ছে। যেখানে গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে এবং সেখানে বিজিবি থাকবে? তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার কক্সবাজারে গেছেন, উখিয়ায় সফর করেছেন এবং তিনি একটি বিরাট বহর নিয়ে গেছেন। আমরা এখন পর্যন্ত যা খবর পেয়েছি তিনি সেখানে কিছু ত্রাণ বিতরণ করেছেন। আমরা শুনে অন্তত এইটুকু খুশি হলাম যে, এতদিন পর বোধোদয় হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসলেন, তুরস্কের ফার্স্টলেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসলেন এবং আজকে প্রথম জাতিসংঘ থেকে একটা বড় মানবাধিকার টিম আসছেন। তারা সেখানে যাবেন। অর্থাৎ সারা বিশ্ব যখন সোচ্চার হচ্ছে, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যখন চিঠি দিয়েছেন নিরাপত্তা পরিষদকে যে, অবিলম্বে এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, তখন আপনি গেলেন উখিয়াতে। : জাতীয় সংসদে নেয়া প্রস্তাবের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, পার্লামেন্টে (জাতীয় সংসদে) কালকে আপনারা (সরকার) প্রস্তাব (রেজুলেশন) নিয়েছেন যে, মিয়ানমারকে চাপ দিতে হবে রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মিয়ানমারকে নিন্দা জানাননি। তারা যে এভাবে গণহত্যা করছে, সুপরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য কাজ করছে তার জন্য কোনো নিন্দা জানাননি, গণহত্যার জন্য কোনো নিন্দা জানাননি। আমরা এই সভা থেকে নিন্দা জানাচ্ছি যে, আপনারা কেন এই প্রস্তাব (নিন্দা প্রস্তাব) নিতে সাহস করেননি। এটা পরিষ্কার, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন প্রধান বলেছেন যে, সুস্পষ্টভাবে মিয়ানমারে গণহত্যা চলছে এবং জাতি ধ্বংস করার নিধনে যেটাকে ইফকিজিং বলে সেটার কাজ করে যাচ্ছে। : প্রধানমন্ত্রীর উখিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এর আগে কী বলেছেন? এর আগে বলেছেন যে, আমাদের দেখতে হবে যে, এখানে সন্ত্রাসী আছে কি না, এখানে দেখতে হবে যে কারা আসছে? এখনো আপনারা দ্বিধান্বিত হয়ে আছেন। মিয়ানমার সীমান্তে মাইন পোঁতা ও বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনায় সরকারের নীরব ভূমিকার সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকে মিয়ানমার যখন তিন লাখ শরণার্থীকে আমাদের দেশে ঠেলে দিয়েছে তখন তো আমার দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আক্রান্ত হয়েছে। তাদের হেলিকপ্টারগুলো ঘুরছে, সীমান্তের পাশেই তাদের সেনাবাহিনীরা মাইন বসাচ্ছে। : বিএনপি সরকারের আমলে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলার বিষয়টি তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, আমার এখনো মনে আছে, ১৯৯২ সালে এভাবে রোহিঙ্গারা আসছিল আমাদের দেশে, তাদের (মিয়ানমার) দেশে উপদ্রব হচ্ছিল। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছিলেন সীমান্তে এবং তিনি বলেছিলেন যে, তোমরা যদি এভাবে এগুতে থাকো তাহলে এই সেনাবাহিনী নিয়ে আমি তোমাদেরকে বাধা দিতে বাধ্য হব। তারা (মিয়ানমার সরকার) কিন্তু মেনে নিয়েছিল, এই রোহিঙ্গাদের ফেরতও নিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়ে ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গারা এভাবে আসছিল, তখন একটা চুক্তি করে তাদের ফিরিয়ে নিয়েছিল। সেই চুক্তির মধ্যে বলা আছে যে, ভবিষ্যতে যেকোনো রকম সমস্যা হলে বসতে হবে, কথা বলতে হবে এবং এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। আপনারা সেগুলো করতে চান না। : মিয়ানমার সীমান্তে দুই দেশের যৌথ অভিযান করার প্রস্তাবের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারাই এটা নিয়ে রাজনীতি করতে চান বলেই সরকার আজকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছেন কী? মিয়ানমারের সীমান্ত রীবাহিনী ও বাংলাদেশের বিজিবি (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) যৌথভাবে টহল দিয়ে অভিযান চালাবে। কার বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে? যাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে, যাদেরকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, যাদের শিশুদের মেরে ফেলা হচ্ছে, যাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। সেখানে বিজিবি থাকবে? আমরা ঠিক বুঝতে পারি না। এটা তারা কী বলতে চান। এটা হচ্ছে যেটা আমি বলেছি যে, পুরোপুরি নতজানু হয়ে গেলে, নিজস্ব কোনো স্বকীয়তা না থাকলে অন্যের ওপর ভর করে যখন চলতে থাকে তখন এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়। আমরা খুব পরিষ্কার ভাষায় জানাতে চাই, আমরা মিয়ানমারের গণহত্যাকে সম্পূর্ণভাবে নিন্দা জানাই, ধিক্কার জানাই। মিয়ানমার সরকারকে বলছি তারা যেন অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ করে। : শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বে সরকারের আমলেই এই ধরনের গণহত্যার ঘটনাকে ‘লজ্জা’ বলে ােভ প্রকাশ করেন মির্জা ফখরুল। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর বর্তমান সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবানও জানান তিনি। : আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে দলটির মহাসচিব বলেন, আপনারা নির্বাচন নির্বাচন বলে খুব ঢোল বাজাচ্ছেন। নির্বাচন এই দেশে আমরাও চাই। কারণ ২০১৪ সালে আপনারা যে নির্বাচন করেছেন তা এদেশের মানুষ গ্রহণ করেনি। জোর করে মতা দখল করে বসে আছেন। আর সামনে যখন নির্বাচনের সময় আসছে তখন আপনারা নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন কথা বলতে শুরু করেছেন। : তিনি বলেন, আমাদের কথা খুব স্পষ্ট যে, আপনারা সংবিধান পরিবর্তন করেছেন। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করেছেন। এক সময় এদেশের মানুষ আপনাদের দেয়া তত্ত্বাবধায়ক প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। তিনবার সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার পর শুধুমাত্র মতায় থাকার জন্য গোটা বাংলাদেশকে অশান্তি, অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তাই আজ যত সংঘাত সমস্যা তৈরি হচ্ছে তার মূলে রয়েছে নির্বাচন। : সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আশা করি আপনাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সহায়ক সরকারের যে প্রস্তাব বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেবেন সেই প্রস্তাব মোতাবেক একটি নিরপে সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। অন্যথায় ইতিহাস এবং জনগণের কাছে দায়ী থাকবেন। জনগণ মা করবে না। : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। উদ্দেশ্য বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে ধ্বংস করে দেয়া। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের বিকল্প নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই সরকারের জনসমর্থন নেই, নেই কোনো শক্তি। তাদের (আওয়ামী লীগ) শক্তি হচ্ছে অস্ত্র, আর্মি, র‌্যাব ও পুলিশ। তাই আমরা (বিএনপি) যদি সঠিক রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করে আন্দোলনে অগ্রসর হতে পারি তাহলে এরা (সরকার) পালানোর পথ পাবে না। : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হলেও বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টির মাধ্যমে জনদৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেয়ার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। : সংগঠনের সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়নের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সিনিয়র সহ-সভাপতি মোরতাজুল করীম বাদরু, সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান, ঢাকা মহানগর যুবদল উত্তরের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন, ঢাকা মহানগর যুবদল দেিণর সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহিন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন যুবদল দক্ষিণের সভাপতি রফিকুল আলম মজনু, যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তরের সিনিয়র সহ সভাপতি মোস্তফা কামাল রিয়াদ, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তফা জগলুল পাশা পাপেল প্রমুখ।