চিরনিদ্রায় শায়িত কণ্ঠযোদ্ধা আবদুল জব্বার

প্রকাশিত: ১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৭

চিরনিদ্রায় শায়িত কণ্ঠযোদ্ধা আবদুল জব্বার

শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিলেন ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানের সাম্পানের নাইয়া কণ্ঠযোদ্ধা আবদুল জব্বার।

বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নাগরিক শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শেষ ঠাঁই নিলেন এই কণ্ঠযোদ্ধা।

একাত্তরের আগুনঝরা দিনগুলোতে তার কণ্ঠে গাওয়া সালাম সালাম হাজার সালাম, জয় বাংলা বাংলার জয়ের মত উজ্জয়নী গানগুলো বাঙালির মুক্তির স্পৃহাকে জাগিয়ে রেখেছিল।

বাংলা সিনেমার প্লেব্যাকেও আবদুল জব্বারের দরাজ কণ্ঠে গাওয়া তুমি কি দেখেছো কভু, পীচ ঢালা এই পথটারে, এক বুক জ্বালা নিয়ে, তারা ভরা রাতে, আমি তো বন্ধু মাতাল নই, বন্ধু তুমি শত্রু তুমির মত অসংখ্য রোমান্টিক গান বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে পাঁচ দশকের বেশি সময়।

তার প্রতি শেষ বিদায় জানাতে এসে এক সময়ের সহযোদ্ধা, সহশিল্পীরা বললেন, কেবলএকজন অসাধারণ শিল্পীকে নয়, দেশপ্রেমিক অসাধারণ একজন মানুষকে হারালো বাংলাদেশ।

স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকজয়ী কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার কিডনি জটিলতার পাশাপাশি হৃদযন্ত্র ও প্রোস্টেটের সমস্যায় ভুগছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ আগস্ট বুধবার সকালে মৃত্যু হয় তার।

৩১ আগস্ট বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টার পর এই মুক্তিযোদ্ধার কফিন জাতীয় পতাকায় মুড়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। রাষ্ট্রীয় বিধি অনুযায়ী ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।

প্রথমে প্রধামন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তার মুখ্যসচিব কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মির্জা আজম, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আক্তারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এই শিল্পীর প্রতি জানানো হয় শেষ শ্রদ্ধা।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ওবায়দুল কাদের বলেন, তিনি ছিলেন বাংলা গানের সুরের জাদুকর। তিনি বাংলা গানের হেমন্ত মুখার্জি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, আমাদের আত্মার আত্মীয়। বঙ্গবন্ধু তাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে যে গানগুলো গেয়েছেন, তা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

বুধবার রাতে আবদুল জব্বারের মরদেহ রাখা হয়েছিল বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে। বৃহস্পতিবার সকালে শহীদ মিনারে নেওয়ার আগে তার কফিন নিয়ে যাওয়া হয় আগারগাঁওয়ে, তার কর্মস্থল বাংলাদেশ বেতারে।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, কাদের সিদ্দিকী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের পাশাপাশি বেতারের কর্মকর্তা ও কলাকুশলীরা সেখানে আবদুল জব্বারের জানাজায় অংশ নেন।

জানাজা শেষে তথ্যমন্ত্রী ইনু, তথ্যসচিব মরতুজা আহমদ, বেতারের মহাপরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদ এই শিল্পীর মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানানো হয়। জাসাসের হয়ে শ্রদ্ধা জানান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

জব্বারের গাওয়া ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, এ গানটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে এই গান। তার গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। এ কারণেই দেশের মানুষ তার গানকে মন থেকে ভালোবেসেছে।

বিসিএস তথ্য-সাধারণ বেতার কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীসংস্থা, রেডিও অ্যানাউনসার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও শিল্পীর কফিনে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ইনু বলেন, আবদুল জব্বার যখন গান গাইতেন তখন সারা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একটা সূচনা হয়েছিল। উনি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ কণ্ঠসৈনিক। সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকতেন এবং পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, গানের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে বাঙালি জাতিস্বত্ত্বার, ঐতিহ্যের পক্ষে ভূমিকা রাখতেন।

তিনি বলেন, উনার গান মানুষের মনে কীভাবে সাড়া জাগাত সেটা দেশবাসী সাক্ষী। জীবনের শেষ দিকেও উনার গান শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক অপেক্ষা করত।

আবদুল জব্বারের সব কাজ সংরক্ষণ করার জন্য বেতার, ডিএফপিসহ সরকারি দপ্তরগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে আমরা ‘মিউজিয়াম অব মিউজিক’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। সেটির মাধ্যমে আমরা আবদুল জব্বারের সংগীতকে সংরক্ষণ করব।

আবদুল জব্বারের বড় ছেলে মিথুন জব্বার তার বাবার বেতারে কাজ শুরুর করার ঘটনা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন, কবি আজিজুর রহমান তাকে নিয়ে গেছেন শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কাছে। বাবার তখন খুব অল্প বয়স। উনি এই রকম বলেছিলেন, এই ছেলেটার গলাটা অনেক ভাল। এরপর তাকে বকশীবাজারে রেডিওতে নিয়ে অডিশন দেওয়ানো হয়। এই রেডিওই তার আজীবন কর্মস্থল ছিল।

মিথুন বলেন, এই রেডিও থেকে তার শুরু। আজ তার আরেকটি জীবন শুরু হচ্ছে, আরেকটা জীবনে প্রবাহিত হবে।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি আবদুল জব্বারের অনুরাগের কথা তুলে ধরে তার ছেলে বলেন, বাবা আমাকে বলত, আমি বাবাকে হারিয়েছি, আমি বাবাকে নিজের মনের মধ্যে রেখেছি। বাবা বলতে তো বুঝছেন… বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার আদরের ছিলেন আমার বাবা। সেই বাবাকে আমরা আজকে গানে গানে রেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে গানের মধ্যে তিনি সবসময় মনে করতেন। আজকে আমার বাবা, আপনাদের বাবা (বঙ্গবন্ধু) উনারা গানে গানে থাকবেন। উনাদের আমরা ধরে রাখব।

মিথুন, উনি লড়াই করেছিল শেষ সময় পর্যন্ত। যতই বয়স হোক না কেন, সিংহ কিন্তু লড়াই করে। বাবা চলে যাননি, এই বেতারের মধ্যেই স্মৃতি হয়ে তিনি আছেন।

বেতারের নিজস্ব শিল্পীসংস্থার মহাসচিব গাজী আবদুল হাকিম বলেন, একটি নক্ষত্রের পতন হল। তিনি আজীবন রাজার মত রাজত্ব করে গেছেন। শেষ দিন পর্যন্ত বেতারে কর্মরত ছিলেন।

বয়স আশির কাছাকাছি হলেও দরাজ কণ্ঠের কারণে আবদুল জব্বার শেষ সময় পর্যন্ত বেতারের নিজস্ব শিল্পী হিসাবে কর্মরত ছিলেন বলে জানান হাকিম।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, বাংলাদেশের গানের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গেছেন আবদুল জব্বার। তার তুলনা তিনি নিজেই।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জানাজার জন্য আবদুল জব্বারের কফিন নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে।

বিকালে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের জন্য নির্ধারিত স্থানে সমাহিত করা হয় একাত্তরের এই কণ্ঠযোদ্ধাকে।