হেফাজতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক, দুই শিবিরেই অস্বস্তি!

প্রকাশিত: ৫:১০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০১৭

হেফাজতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক, দুই শিবিরেই অস্বস্তি!

মঙ্গলবার রাতে গণভবনে হেফাজতে ইসলামের নেতা আল্লামা শফীসহ কওমী মাদ্রাসার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বৈঠকই এখন দেশের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্র-বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোড়ন তুলেছে বৈঠকটি।

বৈঠকটি সরকার ও বিরোধী শিবিরকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। হঠাৎ এ ধরনের বৈঠক সর্বমহলকে নাড়া দিয়েছে। এ নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। পাশাপাশি দুই শিবিরেও সৃষ্টি হয়েছে চরম অস্বস্তি। খোদ সরকারি শিবিরে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। বিশেষ করে এতদিন যারা হেফাজত তথা ইসলামপন্থীদের কঠোর সমালোচনায় সরব ছিলেন তাদেরকে দারুণভাবে আঘাত করেছে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকের কাছেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার নয়। তারা বলেছেন, এমন কোনো সখ্যতা হলে সেটা তাদের দল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে।

তবে আওয়ামী লীগের ভেতরে টানাপড়েনের অভিযোগ নাকচ করে দলটির নীতিনির্ধারকদের অনেকে বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বাদ দিয়ে তারা সকলকে নিয়ে চলতে চান।

সমালোচনা যাই হোক জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দলগুলোর বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের গুরুত্ব যে বেড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে এরাই বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিতে পারে এমন বদ্ধমূল ধারণা দিনে দিনে আরো স্পষ্ট হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। উভয় শিবিরই মনে করে হেফাজত তথা ইসলামপন্থীরা অন্যতম ভোট ব্যাংক। এই ব্যাংক যাদের পক্ষে সমর্থন দিবে তারাই ক্ষমতার আসনে থাকবে।

আর এ কারণেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হেফাজতে ইসলামকে বিভিন্নভাবে কাছে টানার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি গণভবনে হেফাজতে ইসলামের নেতা আল্লামা শফীর নেতৃত্বে তিন শতাধিক আলেম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে হেফাজেতের সুপ্রিমকোর্ট চত্বরের গ্রিক মূর্তি অপসারণসহ বিভিন্ন দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহানুভুতি প্রকাশ করেন।

এর পরই দেশের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নানা হিসাব নিকাশ। চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো ইসলামপন্থীদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন।

এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়পক্ষই ইসলামপন্থীদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সচেষ্ট বলে মনে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখেই এ ধরনের তৎপরতা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সুবিধা নিতেই হেফাজতের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতার চেষ্টা করছে তারা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশের বাস্তবতা মানতে হবে এবং সিংহভাগ মানুষের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেদিক বিবেচনা করেই আলেমদের কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা বিরোধীদের বাদ দিয়ে সকলকে নিয়েই চলেছে। আমরাই বলবো, ইনক্লুসিভ সোসাইটি। আবার স্বাধীনতা বিরোধী বিষাক্তদের বাদ দিয়ে যখন সকলকে নিয়ে চলার কথা আসে, তখন বলা হয় আওয়ামী লীগ আপোষ করছে। আমরা কিছু করলেই প্রশ্ন তোলা হয়। এর মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ চলছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, আমি হেফাজত করি না। তবে হেফাজতের এমন দাবিকে সমর্থন করি।

এছাড়া হেফাজতে ইসলাম ও আলেম-ওলামাদের কাছে টানতে চাইছেন দেশের প্রধান দুই দলের নেত্রীই। এরই মধ্যে তাদের সে ধরনের কিছু তৎপরতাও লক্ষ্য করা গেছে। তাদের বক্তব্যেও সেটা ফুটে উঠেছে।

মঙ্গলবার রাতে গণভবনে কওমী মাদ্রাসার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের লোকেরা আমাদের কওমী মাদ্রাসা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতো। আমি সবসময় এটার প্রতিবাদ করতাম। আমি সবসময় এটাই বলতাম আমাদের দেশে শিক্ষার শুরুই হয়েছে এই কওমী মাদ্রাসা দিয়ে। এটা যদি শুরু না হত তাহলে আমরা কেউ শিক্ষিত হতে পারতাম না। যারা দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাদের বিরাট ভূমিকা ছিল। তারাই প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। কাজেই আজকে যে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি সেখানে তাদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। কারণ সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকেই এই যাত্রা শুরু হয়।

তিনি আরো বলেন, আমি সবসময় মনে করি, আমাদের কওমী মাদ্রাসার একটা সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া একান্তভাবেই দরকার। সেজন্য আমরা আগে আল্লামা শফিকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দিয়েছিলাম- যে কিভাবে এই কারিকুলামটা করা যায়। প্রায় ৬টা মাদ্রাসা বোর্ড আমাদের রয়েছে- তাদের সকলের মতামতটা কি, সেটাকেও আমাদের গুরুত্ব দেয়া। এটাও আমরা করতে চাই এবং সেইসাথে অন্তত, একেবারে সর্বনিম্ন যে পয়েন্টে আপনারা একমত হতে পারেন সে বিষয়ে আপনারা যেন একমত হতে পারেন সেটা আমরা চেয়েছিলাম, যাতে আমরা সনদের স্বীকৃতিটা অন্তত দিতে পারি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আমি শোকরিয়া আদায় করছি যে আজকে আপনারা সকলে মিলে গণভবনে এসেছেন এবং সকলে একমত হয়েছেন যে কওমী মাদ্রাসার সনদের একটা স্বীকৃতির ব্যবস্থা নেবেন।

প্রধানমন্ত্রী আলেমদের উদ্দেশ্যে বলেন, এখানে একটি বিষয় এসেছে আমাদের হাইকোর্টের সামনে গ্রিক থেমেসিসের এক মূর্তি লাগানো হয়েছে। সত্য কথা বলতে কি আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। কারণ গ্রিক থেমেসিসের মূর্তি আমাদের এখানে কেন আসবে। এটাতো আমাদের দেশে আসার কথা না। আর গ্রিকদের পোষাক ছিল একরকম, সেখানে মূর্তি বানিয়ে তাকে আবার শাড়িও পরিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাও একটা হাস্যকর ব্যাপার করা হয়েছে। এটা কেন করা হলো, কারা করলো, কিভাবে- আমি জানি না। ইতোমধ্যেই আমাদের প্রধান বিচারপতিকে আমি এই খবরটা দিয়েছি এবং খুব শীঘ্রই আমি ওনার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বসবো। আলোচনা করবো এবং আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা এখানে থাকা উচিত নয়।

এতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে খোদ সরকারি শিবিরেও। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়। হেফাজতের দাবি এতটুকু গুরুত্ব পেলে, দেশের সব ভাস্কর্য ভাঙার দাবি উঠবে।’ সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর বলেছিলেন, ‘এটা ইসলামি রিপাবলিক নয়!’

শরিক দলের মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলছেন, ‘তোষণ করলেও মৌলবাদীরা হাসিনাকে ভোট দেবে না। বরং অসাম্প্রদায়িক ভোটাররাই সরে যেতে পারেন।

শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বলেছে, ‘কেউটের লেজ দিয়ে কান চুলকোনোর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজত তথা আলেমদের বৈঠকের পর অস্বস্তিতে পড়েছে বিরোধী শিবিরও। কেননা, এতোদিন তাদের ধারণা ছিল- হেফাজত তথা ইসলামপন্থীরা তাদের সমর্থনেই রয়েছে। কিন্তু তাদের সে ধারণায় আঘাত হেনেছে এই বৈঠক।

বুধবার বিকেলে গুলশানে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে সেই অস্বস্তির কিছুটা প্রতিফলনও লক্ষ্য করা গেছে। তিনি বলেছেন, দেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতিকে এক্সপ্লয়েট করার জন্য শেখ হাসিনা ভারত সফরের আগে আলেম সম্মেলন করেন। ফিরে এসে মঙ্গলবারই আবার হেফাজতে ইসলাম প্রভাবিত কওমী মাদ্রাসার ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

তিনি আরো বলেন, আলেমদের সঙ্গে তার অতীত আচরণ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ক্রমাগত আঘাতের কথা দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। এখন তিনি নিজেই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। অতীতেও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার লক্ষ্যে দেশে ইসলামী শরিয়তী আইন চালুর জন্য একই ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন।

খালেদা জিয়া আরো বলেন, অতীতেও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার লক্ষ্যে দেশে ইসলামী শরিয়তী আইন চালুর জন্য একই ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। এখন কওমী মাদ্রাসা সনদকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলে ধোঁকা দিচ্ছেন। আমাদের সরকার দায়িত্বে থাকার সময় মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন করা হয়েছিলো। ২০০৬ সালে কওমী মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতি আমাদের সরকার দিয়েছিল। সেটা গেজেট নোটিফিকেশনও হয়েছিল।

ফলে সহজেই অনুমেয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজতের বৈঠক নিয়ে উভয় শিবিরেই বড় ধরনের অস্বস্তি শুরু হয়েছে। এই অস্বস্তি থেকে দুই জোটে ভাঙ্গনের গুঞ্জনও ভেসে বেড়াচ্ছে। এখন দেখার বিষয় এর শেষ পরিণতি কী?